ঘণ্টায় ২০, একদিনে ৫৬০ জন

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছেই

হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছেই

রাজধানীর সরকারি-বেরসকারি হাসপাতালগুলোর কেবিন, ওয়ার্ড, বারান্দাসহ সব জায়গায়ই ডেঙ্গু রোগী ভর্তি। চলতি মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসপাতালে রোগীদের ঠাঁই হচ্ছে না, মিলছে না সিট। দিন দিন ডেঙ্গু পরিস্থিতি জটিল রূপ ধারণ করেছে। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫৬০ জন। অর্থাৎ ঘণ্টায় ২০ জন। এবার ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা।

উচ্চতাপমাত্রার জ্বর, তীব্র ব্যথা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে যেতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও অস্পষ্টতায় আছেন চিকিৎসকরা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। যশোরে শনাক্ত হয়েছে ১২ রোগী। চট্টগ্রামে শনাক্ত হয়েছে ৩১ রোগী। ওখানকার জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেছেন, রোগীরা ঢাকা থেকে আক্রান্ত হয়েছে।

এদিকে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে ডেঙ্গু। রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার রোগী। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী এরই মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে মারা গেছে পাঁচজন। এ ছাড়া গতকাল মঙ্গলবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. সাহাদৎ হোসেন হাজরা (৫৩) মারা গেছেন। এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো।

চিকিৎসকরা বলছেন, অন্যান্য বছরের মতো তীব্র জ্বর, মাথা ব্যথা, গায়ে র‌্যাশ ও বমি বমির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না এবার ডেঙ্গু রোগীদের। কারণ ডেঙ্গুর ধরন বদলেছে। এখন ডেঙ্গু হলে সামান্য জ্বরেই রোগীর হার্ট, কিডনি ও ব্রেইন আক্রান্ত হচ্ছে। যে কারণে রোগীর মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ছে অন্যান্য বছরের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। একই সঙ্গে রোগী দ্রুত শকে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা বেড়েছে।

জানা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি থাকায় নতুন কোনো রোগী ভর্তি করতে পারছে না বেসরকারি হাসপাতালগুলো। বেসরকারি হাসপাতালের নির্দিষ্ট সিট কিংবা কেবিন সবগুলোতেই রোগী ভর্তি। স্বজনরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়াচ্ছেন। উপায় না পেয়ে সরকারি হাসপাতালের বারান্দা কিংবা খালি যেকোনো জায়গায় অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে রোগীরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত গরমে এডিস মশার প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকছে। এসব জায়গায় এডিস মশা ডিম পাড়ছে। যে কারণে হঠাৎ এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। আর এ কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপও ক্রমেই ভয়াবহ আকার ধারণ করছে।

সরকারি হিসাব মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৭ হাজার ১৭৯ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছে ৫ জন। এ ছাড়া চলতি মাসের মাত্র ২১ দিনেই এ মৌসুমের সর্বোচ্চ ৪ হাজার ৪৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন।

তবে খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারাই বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সঠিক সংখ্যা স্বাস্থ্য অধিদফতরে নেই। সরকারি হিসাবে শুধু হাসপাতালে যেসব রোগী ভর্তি হচ্ছে, তাদের হিসাব রয়েছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতরের তাগাদা সত্ত্বেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা রাজধানীর সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে পাঠানো হচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৪৭৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি ঘণ্টায় ২০ রোগী ভর্তি হচ্ছে।

এদিকে এবার ডেঙ্গুর লক্ষণ ভিন্ন হওয়ায় বাড়ছে প্রাণহানির আশঙ্কা। উচ্চতাপমাত্রা, তীব্র ব্যথা না থাকায় চিকিৎসকের কাছে যেতে যেমন দেরি হচ্ছে, তেমনি চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়েও আছে বিভ্রান্তি।

এ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ন্যাশনাল গাইডলাইন ২০১৮-এর নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, প্লেটলেট কমে গেলেই রক্ত দিতে হবে, এ ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে রক্তের ঘনত্ব নির্ণয় করে দিতে হবে চিকিৎসা। একই সঙ্গে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে রক্তের অণুচক্রিকা নয়, গুরুত্ব দিতে হয় ঘনত্বের দিকে।

তারা আরো বলছেন, একটা সময় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় প্লাটিলেট হিসাবই সবার আগে বিবেচনা করা হতো। আর প্লাটিলেট লাখের নিচে নামলেই দেওয়া হতো রক্ত। তবে ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট ন্যাশনাল গাইডলাইন ২০১৮ সালে এসেছে নতুন নির্দেশনা। তাই চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্লাটিলেট দিয়ে রোগীর অবস্থা জানলেও ১০ হাজারের নিচে নামলে কিংবা অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণের আগে দিতে হয় না রক্ত।

এ বিষয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, আমার হাসপাতালে এখন ১১২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছে, এর মধ্যে আজ (বুধবার) ভর্তি হয়েছে ৪৩ জন। আমরা এখানে আলাদা করে ডেঙ্গু কর্নার চালু করেছি, সেই সঙ্গে আউটডোরেও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বিশেষ সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আজ এখানে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের একটি সভার আয়োজন করা হয়েছে যেখানে ডেঙ্গু চিকিৎসা ও সচেতনতার নানা দিক তুলে ধরা হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম মনির হোসেন বলেন, যে পর্যায়ে রোগী শকে চলে যায়, ওটার নাম ডেঙ্গুর শক সিন্ড্রোম। ডেঙ্গুর শক সিন্ড্রোম মানে হলো রক্তনালির পুরগুলো খুলে যাওয়া, প্লাজমা লিকেজ হয়ে যায়। প্লেটলেট এখন আমরা দিচ্ছি না, প্লেটলেট এখন জরুরি না। কিন্তু প্লেটলেট দেখে আমরা রোগীর অবস্থান শনাক্ত করি। রোগী খারাপের দিকে যাচ্ছে, নাকি ভালোর দিকে।

পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আগে থেকেই হার্ট, কিডনি সমস্যা আছে, শিশু, প্রসূতি মা কিংবা যাদের ওজন একটু বেশি তাদের চিকিৎসায় বাড়তি সতর্কতা রয়েছে।

এদিকে ঢাকা সিটিতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়াসহ এডিস মশা নির্মূল ও ধ্বংসের কার্যক্রমের বিষয়ে জানাতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের তলব করেছেন হাইকোর্ট।

এমআই