বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রের উপ-সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী

বাংলাদেশের সমুদ্রপথ উন্মুক্ত রাখার তাগিদ

বাংলাদেশের সমুদ্রপথ উন্মুক্ত রাখার তাগিদ

ঢাকা, ৩১ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের রাখাইনে নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল চেষ্টায় তাদের ওপর চালানো বর্বরতার জন্য দায়ী বর্মী সেনা সদস্যদের বিচারের দাবিতেও বরাবরের মতো সোচ্চার থাকবে ট্রাম্প প্রশাসন।

ঢাকা সফরকারী যুক্তরাষ্ট্রের উপ-সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডেনিয়েল রোজেনব্লাম রাজধানীর ইস্কাটনে দেয়া একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এমনটাই জানিয়েছেন। বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল’ শীর্ষক ওই বক্তৃতার আয়োজন করে।

সেখানে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনসহ দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধি, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, গবেষক, শিক্ষাবিদ এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বিস চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমদের সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা রাখেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আবদুর রহমান।

জানুয়ারিতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দক্ষিণ ও মধ্যএশিয়া দেখভালে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপ-সহকারী মন্ত্রী রোজেনব্লামের প্রথম বাংলাদেশ সফর উপলক্ষে আয়োজিত একক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেন। এ অঞ্চল তথা বাংলাদেশের সমুদয় সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশীদারিত্ব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় বাংলাদেশের অবদানকে যুক্তরাষ্ট্র উচ্চপর্যায়ে মূল্যায়ন করে।

দীর্ঘ বক্তৃতায় তিনি এ অঞ্চলের অভূতপূর্ণ সাফল্য সত্ত্বেও বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে বাণিজ্য বাড়াতে সমুদ্রপথ উন্মুক্ত রাখার তাগিদ দেন। বক্তৃতা শেষে প্রশ্নোত্তর সেশনে অভ্যাগত সুধীজনদের অনেকে ‘সমুদ্র পথ উন্মুক্ত রাখার’ আহ্বানের ব্যাখ্যা চান। কেউ কেউ এ-ও প্রশ্ন করেন এ অঞ্চলে চীনের প্রভাববলয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে যুক্তরাষ্ট্র ‘সমুদ্র পথ উন্মুক্ত রাখার’ এ তাগিদ দিচ্ছে কি-না?

জবাবে অত্যন্ত খোলাখুলিভাবেই ট্রাম্প প্রশাসনের ওই প্রতিনিধি বলেন, না, চীনকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে নয় বরং ইতিবাচক কারণেই আমরা এটি বলছি। তিনি বক্তৃতায় যেমনটি বলেছিলেন, প্রশ্নোত্তর পর্বেও তার পুনরুল্লেখ করেন।

বলেন, একটি দেশের নিজস্ব নিরাপত্তা এবং বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সমুদ্রপথ উন্মুক্ত রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওই দেশে বা অঞ্চলের বিভিন্ন দুর্যোগে দ্রুত সাড়া দেয়ার জন্য এটি জরুরি। বক্তৃতা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে মার্কিন ওই কর্মকর্তা বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান সম্পর্ক, রিজিওনাল কানেটিভিটি, জ্বালানী নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা ফেরত পাওয়া না পাওয়া নিয়ে কথা বলেন।

তার মতে, বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বার্থ এবং সার্বভৌম অবস্থান থেকেই যে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে- এটা স্বাভাবিক। স্থগিত থাকা জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের প্রশ্নে উপ-সহকারী মন্ত্রীর পাশাপাশি ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট কথা বলেন।

রাষ্ট্রদূতের ভাষ্য মতে, এলডিসি কান্ট্রিগুলো এ সুবিধা পায়। কিন্তু বাংলাদেশ এলডিসি থেকে ক্রমেই মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছে। তাছাড়া জিএসপি সুবিধায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্যের বিষয়টিও বিবেচিত হয়। সার্বিক বিবেচনায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশের জিএসপি ফেরত পাওয়া কঠিন, তবে এটি হলে আশ্চর্যজনক হবে না। অনুষ্ঠানে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে মহানুভবতা প্রদর্শন করেছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন মার্কিন ওই প্রতিনিধি।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেন, সবার অংশগ্রহণে একটি সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তেই আমরা উভয় জাতি কাজ করছি। এ অঞ্চলের সম্পর্কে মার্কিনীদের সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, সেক্রেটারি টিলারসনসহ আমাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিদের বক্তৃতা এবং গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে এই অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে।

ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সাফল্য কোনো বিমূর্ত ধারণা নয় বরং এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র খুবই যত্নশীল উল্লেখ করে তিনি বলেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সন্ধিস্থলে কৌশলগত অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র অনেক গুরুত্ব দিয়ে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বিস্তৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম সমুদ্রসীমা রয়েছে এবং বেশ কয়েকটি দীর্ঘ মেয়াদী মৈত্রী-জোটের সঙ্গে ওয়াশিংটনের চুক্তি রয়েছে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম অত্যাধুনিক নৌ ইউনিট, প্যাসিফিক ফ্লিট রয়েছে। যা এ অঞ্চলের সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে অসংখ্য যৌথ মহড়া করেছে এবং প্রায় প্রতিটি দেশের সামরিক বাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছে।

এই অঞ্চল জঙ্গিবাদ মোকাবিলা এবং ভারত সাগর থেকে দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে নৌ-চালনার স্বাধীনতা এবং বৈশ্বিক নিয়ম মেনে চলার ক্ষেত্রে বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই প্রসঙ্গে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা অংশীদারিত্বের কদর করি।

বৃহত্তর আঞ্চলিক যোগাযোগের ফলে প্রতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগতভাবে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি লাভবান হতে পারত উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রাথমিক পূর্বশর্ত হচ্ছে আইনের শাসনবিধি ও মৌলিক আন্তর্জাতিক নিয়মের জন্য আঞ্চলিক প্রতিশ্রুতি। আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, অর্থপূর্ণ, আইন-ভিত্তিক আচরণবিধি দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব নিরাপত্তা, অধিক হারে বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সমুদ্রপথ উন্মুক্ত রাখা, দুর্যোগের সময় দ্রুত সাড়া দেয়ার ব্যাপারে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি নিরাপদ এবং স্থায়ী আঞ্চলিক পরিবেশ স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সুযোগ সৃষ্টি করে যা মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনে মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছে দেয়।

সমুদ্র সীমার বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশ একটি আদর্শ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০১২ সালে বাংলাদেশ-মিয়ানমার এবং ’১৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা বিরোধের বন্ধুত্বপূর্ণ সমঝোতা প্রমাণ করে যে আন্তর্জাতিক আইন মেনে কিভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়।

এ অঞ্চলের উন্নয়নে জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়ার মতো সম-মানসিকতার অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে জানিয়ে তিনি বলেন, সামুদ্রিক এলাকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, সাইবারসিকিউরিটি, এবং মানবিক সহায়তা, দুর্যোগ ত্রাণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নই তাদের সম্পর্কের মূল ফোকাস। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়া বা বৃহত্তর অঞ্চলের যে কোনো দেশের সঙ্গে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, সমৃদ্ধশালী, নিরাপদ, এবং একটি আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে সন্নিহিত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল তৈরিই আমাদের লক্ষ্য।

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১০৫২ঘ.)