রোহিঙ্গা ক্যাম্প: ২ বছরে খুন ৪৩, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৩২

রোহিঙ্গা ক্যাম্প: ২ বছরে খুন ৪৩, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত ৩২

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনের মুখে মাতৃভূমি রাখাইন রাজ্য থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এ সময়ের মধ্যে দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাদের অনীহার কারণে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। ফলে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয়দের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।

বিশেষ করে এ দুই বছরে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে খুন-হত্যার মতো ঘটনা বেড়েছে। পাশাপাশি মাদক ও মানবপাচারের মতো অভিযোগে অনেক রোহিঙ্গাকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারাতে হয়েছে। শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দা হয়ে এরই মধ্যে হাজারো রোহিঙ্গা বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে রয়েছে অস্বস্তি আর অস্থিরতা। সামনের দিনগুলো নিয়ে তাদের মধ্যেও এক গভীর অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন শুরু করে। ফলে প্রাণ বাঁচাতে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়।
এর আগে থেকেই বাংলাদেশে আরো প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছিল। উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে এখন ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। তবে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭। তাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এ ব্যাপারে সহযোগিতার জন্য বিশ্বের প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশের প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে। কিন্তু দুবার উদ্যোগ নিয়েও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যায়নি। সবশেষ গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু কোনো রোহিঙ্গাই যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি।

এর আগে ১৫ নভেম্বরও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। কিন্তু সেবারও রোহিঙ্গারা জানায়, তারা দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। এ অবস্থার মধ্যেই আজ রোহিঙ্গা প্লাবনের দুই বছর হতে চলেছে।

কক্সবাজার জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছে ৪৩ রোহিঙ্গা। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে আরো ৩২ রোহিঙ্গা। এ ছাড়া ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানবপাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। যার মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী-সংক্রান্ত মামলা ৩১টি। এসব মামলার আসামি এক হাজার ৮৮ রোহিঙ্গা।

অন্যদিকে স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, প্রত্যবাসন বিলম্বিত হওয়ায় দিন দিন রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। পাশাপাশি তারা চুরি ও হত্যাসহ বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটছে। রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে সংগঠিত বাহিনী আছে।

উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেছেন, ‘উখিয়া-টেকনাফের ৩৩টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বিপুল এই জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করা অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

এদিকে দেশি-বিদেশি দাতা সংস্থাগুলোর কারসাজিতে পরপর দুবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। রোহিঙ্গাদের এমন অপরাধ কর্মকাণ্ড ও সহিংস আচরণ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকেও ভাবিয়ে তুলেছে।’

‘কক্সবাজার বাঁচাও’ আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান দাবি করেন, রোহিঙ্গারা বেপরোয়া হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধে জড়াচ্ছে। স্থানীয়দের কেউ কেউ নিহত হয়েছেন রোহিঙ্গাদের হামলায়। রোহিঙ্গাদের হামলার শিকার হয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও। স্থানীয়রা রোহিঙ্গা আতঙ্কে ভুগছেন। ভবিষ্যতে স্থানীয়রা আরো কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন আয়াছুর।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম. গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আগে রোহিঙ্গারা খাবারসহ নানা প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য দৌড়াদৌড়ি করত। এখন তাদের খাবার ও সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসের জন্য কোথাও দৌড়াতে হয় না। এনজিওরা তাদের ঘরে ঘরে সব প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দিচ্ছে। কোনো কাজ ও সংসারের পিছুটান না থাকায় রোহিঙ্গারা নানা অপকর্মে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে ইয়াবা-রাজ্য বানিয়েছে। ধর্ষণ, খুন ও হামলা তাদের নিয়মিত কাজে পরিণত হয়েছে। তাদের কারণে স্থানীয়রা এখন অসহায় হয়ে পড়েছেন। নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তাঁরা।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ দমনে প্রতিনিয়িত র‌্যাবের অভিযান চলছে। পাশাপাশি মাদক পাচারে জড়িত বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। র‌্যাবের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। টহল জোরদার করেছে র‌্যাব।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসেন বলেন, প্রতিদিনই বাড়ছে রোহিঙ্গাদের মামলার সংখ্যা। হত্যা, চুরি ও মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। নিয়মিত টহল ও অভিযান জোরদার করেছে পুলিশ। কঠোর অবস্থান ও নজরদারি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এমআই