গচ্চার আরেক নজির ঢাকা ওয়াসায়

২২০ কোটি টাকার পাম্পিং স্টেশন শুরু থেকেই বিকল

২২০ কোটি টাকার পাম্পিং স্টেশন শুরু থেকেই বিকল

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ২২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ঢাকা ওয়াসার দুটি পাম্পিং স্টেশন বিকল হয়ে আছে চালু হওয়ার পর থেকেই। আধুনিক প্রযুক্তির এই স্টেশনে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কারণে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না পাম্প দুটি। ফলে প্রয়োজনের সময় কোনো কাজেই আসছে না ওই পাম্প স্টেশন। এ দুটির একটি রামপুরায়, আরেকটি কমলাপুরে। কমলাপুরের স্টেশনটি বিকল্প উপায়ে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চালানো হচ্ছে। রামপুরার স্টেশনটি কেবল কয়েক দিনের জন্য চালু হয়েছিল ২০১৬ সালে। এ ছাড়া এটা আর ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। রামপুরার পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে ২৫ হাজার লিটার পানি নিস্কাশনের কথা। কমলাপুর স্টেশনের মাধ্যমে ১৫ হাজার লিটার। চলতি বর্ষা মৌসুম শুরু হলে ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের লোকজন রামপুরা স্টেশনের অবস্থা পর্যবেক্ষণে যান। দেখেন, সেটির একটি যন্ত্র নষ্ট। মেরামতের জন্য ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আনার কাজ চলছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল কেউ কথা বলতে রাজি নন।

ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের সঙ্গে কথা বলতে তার কার্যালয়ে গেলে সংস্থাটির উপপ্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা মোস্তফা তারেক জানান, আগামী কিছুদিন তিনি কোনো ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন না। পুরো বিষয়টি তাকে অবহিত করলে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, 'পাম্পের যে বিষয়গুলোর কথা আপনি বললেন, সেটা আমি এমডি মহোদয়কে অবহিত করব। তিনি কথা বলার প্রয়োজন মনে করলে আপনার সঙ্গে আমরাই যোগাযোগ করব।'

পাম্প দুটি পরিচালনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঢাকা ওয়াসার ড্রেনেজ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার জন্য সেগুনবাগিচায় তার কার্যালয়ে গেলে বলেন, 'একবার ধোলাইখালে একটি জলাশয় পরিদর্শনে যাওয়ার পর এক টিভি সাংবাদিক তার কাছে জানতে চান, কবে থেকে জলাশয় আধুনিকায়নের কাজ শুরু হবে। কবে থেকে জলাশয়ের ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হবে। উত্তরে বলেছিলাম, আমি বলতে পারব না। ওই টিভি চ্যানেলে রিপোর্ট হলো যার দায়িত্ব জলাশয় রক্ষা করার, তিনিই কিছু জানেন না। এরপর থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি মিডিয়ার সঙ্গে আমি কোনো কথা বলব না। তবে বলতে পারি, এ জন্য এমডির (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) অনুমতি লাগবে।'

তবে রামপুরা পাম্প স্টেশনের মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুল আলম বলেন, '২০১৮ সালের মার্চ মাসে আমাকে এটা দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে এটা কখনও চলেনি। সম্প্রতি একটি জিনিস নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা মেরামতের জন্য যে ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী প্রয়োজন, সেটা বাংলাদেশে নেই। সিঙ্গাপুর ও ভারতে আছে। ভারত থেকে সেই বিশেষজ্ঞকে আনার জন্য পাম্প স্টেশন স্থাপনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বলা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ২২ লাখ টাকা খরচ হবে। এখন তাকে আনার কাজ চলছে।'

তিনি আরও বলেন, এই পাম্পটি চালানোর কৌশল শেখার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আমাকে চীনে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো কিছু শেখায়নি। ১০ দিন ঘুরেফিরে চলে আসি। ফলে আমিও আসলে জানি না কোনো সমস্যা হলে কী করতে হবে। কাজেই বসে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে দমকল পদ্ধতিতে পাম্পিং করতে বিদ্যুতের খরচ বেশি হয় বিধায় তখন এ প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সবসময় ২৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নিচে এই পাম্পের মেশিনারিগুলো রাখতে হয়। এ জন্য মেশিন রুমে ২০-২৫টা এসি লাগানো আছে। এ জন্য মাসে বিদ্যুতের বিল ওঠে তিন লাখ টাকা।' তিনি জানান, এই পাম্পটাতেও সমস্যা আছে। কমলাপুরের পাম্পেও একই সমস্যা।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১২ সালে রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে রামপুরা ব্রিজের পাশে ও কমলাপুর স্টেডিয়ামের পাশে দুটি আধুনিক পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ঢাকা ওয়াসা। রামপুরার পাম্পের মাধ্যমে হাতিরঝিলের পানি পাম্পিং করে রামপুরা খালে ফেলা হবে ও কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে সেগুনবাগিচা, ফকিরাপুল, মালিবাগ, কাকরাইল, মতিঝিলসহ আশপাশের পানি নিস্কাশন করা হবে। কারণ, বর্ষা মৌসুমে রাজধানীর পূর্বাঞ্চলের পানির স্তর রাজধানীর পানির স্তরের চেয়ে উঁচু হয়ে যায়। ফলে স্বাভাবিকভাবে রাজধানীর পানি বাইরে প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। এ জন্য অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। এ প্রকল্পের জন্য ঢাকা ওয়াসার তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী আব্দুল আজিজকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়। মূলত তার তত্ত্বাবধানেই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়। আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয় সে সময়। কাজ পায় চীনা প্রতিষ্ঠান সিএএমসি। কিন্তু শুরু থেকেই প্রকল্পে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের অভিযোগ উঠতে থাকে। ২০১৪ সালে পাম্পিং স্টেশনের কাজ সম্পন্ন করে। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ওয়ারেন্টি পিরিয়ড হিসেবে দুই বছর তারা পাম্প দুটির তত্ত্বাবধান করবে। পরে তারা ওয়াসার কাছে সম্পূর্ণ ন্যস্ত করবে। এরপর তাদের কোনো দায় থাকবে না। তবে এ সময়ে পাম্প দুটি পরিচালনার জন্য ঢাকা ওয়াসার একটি টিমকে দক্ষ হিসেবেও গড়ে দিয়ে যাবে। কিন্তু তারা ঢাকা ওয়াসার কাউকে সেভাবে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলেনি। ওয়াসাও গা-ছাড়া দিয়েছিল। যে সময়ে সিএএমসি তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিল, ওই সময়েও পাম্প দুটি কোনো কাজে আসেনি। ওয়াসার হাতে ন্যস্ত করার সময় ২০১৬ সালে রামপুরা পাম্পটি কয়েক দিনের জন্য চালু করেছিল। পরে আর চালু করা সম্ভব হয়নি। আর কমলাপুরের পাম্পটি অচল থাকার কারণে পরে ওয়াসা বাধ্য হয়ে পাশেই পুরনো দমকল পদ্ধতিতে ফিরে যায়। সেখানে ওই পদ্ধতিতে পাম্পিংয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। আর মাঝে মাঝেই একেকটি যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন মেরামতের জন্য ২০-২৫ লাখ টাকা খরচ হচ্ছে।

সরেজমিন রামপুরা পাম্পিং স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনটি তৈরির জন্য রামপুরা ব্রিজের পাশে একটি স্লুইসগেট তৈরি করা হয়েছে। গেট দিয়ে সেই পানি পাম্পিং স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত একটি ওয়াটার পন্ডে জমা হয়। সেই পানি নিস্কাশনের জন্য মূল স্টেশনে রয়েছে তিনতলার একটি অবকাঠামো। মূল মেশিনারিগুলো তৃতীয় তলায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে। আর নিচতলায় রয়েছে পাঁচটি পাম্পের সেটআপ। একইভাবে কমলাপুর পাম্পিং স্টেশনে রয়েছে তিনটি পাম্পের সেটআপ। একেকটি পাম্প প্রতি সেকেন্ডে ৫ হাজার লিটার পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা থাকার কথা। কিন্তু সেগুলো কোনো পানিই নিস্কাশন করতে পারছে না।

এ প্রসঙ্গে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী ও এ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) আব্দুল আজিজ বলেন, 'প্রথমে আবুল কাশেম নামের একজন পিডি ছিলেন। পরে আমি হই। ওয়াসায় থাকার সময় এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। নিম্নমানের জিনিসপত্র দেওয়ার অভিযোগ যে কেউ করতে পারে। কিন্তু একটা কাজ করতে গেলে সেটা মন্ত্রণালয় দেখে। বিশ্বব্যাংকের ওয়াশিংটন অফিসে পাঠাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা পরীক্ষা করেন। অনেক কিছু অনুসরণ করেই তো করা হয়। তবে অনেক আগেই যেহেতু আমি ওয়াসা থেকে অবসর নিয়েছি, তাই এখন আর এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না।'

শুরুতেই অনিয়ম :জানা যায়, দুটি পাম্পিং স্টেশন নির্মাণের আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের পর ছয়টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করে। এর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হয় চীনা কোম্পানি সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। ওই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশি এজেন্ট ছিল সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের কোম্পানি সাকো ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু তখন পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে সাকো ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে সমালোচনা তুঙ্গে। আর দ্বিতীয় সর্বনিম্ন দরদাতা হয় কোরিয়ান কোম্পানি হাইওয়াং ইবারা। ওই সময় ওয়াসার পক্ষ থেকে বলা হয়, সাকো ইন্টারন্যাশনালকে কাজ দিলে বিশ্বব্যাংক অখুশি হতে পারে। এ জন্য লোকাল এজেন্ট পরিবর্তন করতে হবে। তখন আজিজুল আকিল ডেভিড নামের এক ব্যক্তি সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের বাংলাদেশি এজেন্ট হন। মূলত আজিজুল আকিল ডেভিডই পরে পাম্প দুটি নির্মাণ করেন। এ ঘটনায় সাকো ইন্টারন্যাশনাল ওয়াসায় অভিযোগও দায়ের করে। ওয়াসা তা আমলে নেয়নি। এ প্রসঙ্গে সাকো ইন্টারন্যাশনালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মো. ফারুক বলেন, 'তখন তারা একটা অভিযোগ দিয়েছিলেন। তবে সত্য কথা হলো, পাম্প দুটি নির্মাণের পর থেকেই ঠিকমতো চলছে না। এর ফলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকার বাসিন্দারা জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়ছেন।'

অবশ্য এ প্রসঙ্গে সিএএমসির বাংলাদেশের এজেন্ট আজিজুল আকিল ডেভিড বলেন, 'দুই বছর ওয়ারেন্টি পিরিয়ড ছিল। ওই সময়ের মধ্যে ওয়াসার সঙ্গে যত ধরনের চুক্তি ছিল, সবকিছু আমরা পূর্ণ করেছি। তখন ওয়াসা কোনো অভিযোগ করেনি। এখন যদি কেউ বলে নিম্নমানের জিনিসপত্র দেওয়া হয়েছে, সে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। এমনকি পাম্প চালানোর জন্য ওয়াসার লোকদের বিদেশে নিয়ে ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করেছি। কেউ যদি ঠিকমতো প্রশিক্ষণ না নেয়, তাহলে সেটা প্রশিক্ষাণার্থীর দায়, প্রশিক্ষকের নয়।'

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক ম ইনামুল হক বলেন, 'ঢাকা ওয়াসা সাভারের ভাকুর্তাতে একটা প্রকল্প করেছে, সেখানে নাকি পানির খনির আছে। অথচ এখন তারা পানি পাচ্ছে না সেখানে। সেখানেও অনেক টাকা খরচ করেছে তারা। এগুলো বলতে গেলে তারা বলে, তাদের পেছনে লেগেছি। আর ওয়াসার দায়িত্বশীলদের সঙ্গে তো কথা বলাই মুশকিল। এ জন্য ওয়াসা নিয়ে কথাও বলতে চাই না।' সূত্র : সমকাল

এমজে/