লুটপাটে ডুবল ৩৮শ কোটি টাকার প্রকল্প

লুটপাটে ডুবল ৩৮শ কোটি টাকার প্রকল্প

মুন্সীগঞ্জের যশলদিয়া থেকে পদ্মার পানি পরিশোধন করে ঢাকায় সরবরাহের প্রকল্প শেষ হয়েছে আট মাস আগে। কিন্তু এখনো তা চালু হয়নি। সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে একবার চালু করা হলেও পাঁচ মিনিটেই পানির পাইপ ফেটে ভেস্তে গেছে পুরো প্রকল্প। কম পুরুত্বের নিম্নমানের পাইপ ব্যবহারে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যবহৃত পাইপ বুয়েটে পরীক্ষা করা হয়নি। এভাবেই লুটপাট এবং অনিয়মে ডুবতে বসেছে ওয়াসার ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকার এই প্রকল্প।

নিম্নমানের বলে অভিযুক্ত এই ‘কে৯’ পাইপ সরবরাহ না করতে ঠিকাদারকে চিঠি দেওয়ায় সরিয়ে দেওয়া হয় প্রকল্প পরিচালককে। ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী এম এ রশীদ সিদ্দিকী। চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে দেওয়া ওই চিঠিতে প্রকল্প পরিচালক লেখেন- ‘ঢাকা ওয়াসার সাথে এই প্রকল্পের চুক্তি অনুযায়ী ‘কে৯’ ডাকটাইল পাইপ গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ঢাকা ওয়াসার অনুমোদন ছাড়া এই পাইপ না পাঠানোর জন্য বলা হচ্ছে।’ এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান সংস্থার তৎকালীন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজউদ্দিন (গবেষণা, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) এবং প্রধান প্রকৌশলী আবুল কাশেমকে অনেকটা ধমক দিয়ে মেইল করেন। বলেন, ‘এসব কী চলছে?’ ২০১৪ সালের ৯ অক্টোবর রাত ৮টা ৫৬ মিনিটে পাঠানো ওই মেইলে তিনি আরও লেখেন, ‘আপনারা কি ওই চিঠি সম্পর্কে অবগত আছেন? প্রকল্প পরিচালক এগুলো কী করছে? তিনি কেন ওই চিঠি আপনার সাথে আলোচনা না করে লিখেছে? তাকে বলে দেন, আর একটা শব্দও যেন আমাকে বা আপনাকে জিজ্ঞেস না করে লেখা হয়।’ তিনি এই মেইলের অনুলিপি দিয়েছিলেন উপ-প্রকল্প পরিচালক রফিকুল ইসলাম এবং স্থানীয় ঠিকাদার অ্যারিডড গ্রুপের পরিচালক আজিজুল আকিল ডেভিডকেও।

একইভাবে ওই দিন রাত ৯টা ২৭ মিনিটে উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সিরাজউদ্দিন প্রকল্প পরিচালক এম এ রশীদ সিদ্দিকীকে মেইল পাঠান। তিনি লেখেন- ‘এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা না বলে ঠিকাদারকে মেইল পাঠানোয় আমি অবাক হচ্ছি। এটি পুরো প্রক্রিয়াকে জটিলতায় ফেলেছে। আপনাকে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে এবং এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।’ এরপর প্রকল্প পরিচালকের পদ থেকে প্রকৌশলী এম এ রশীদ সিদ্দিকীকে সরিয়ে মো. রফিকুল ইসলামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

মাঠ পর্যায়ে এ প্রকল্পের দুর্নীতি আরও দৃশ্যমান। প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পানি পরিশোধন করে পাইপ যশলদিয়া থেকে পদ্মা, ধলেশ্বরী ও বুড়িগঙ্গা নদী পার করে ঢাকা আনতে হবে। তিনটি নদী পারাপারে চুক্তি মোতাবেক ২ দশমিক ৫ মিটার ব্যাসের কেসিং পাইপ বসানোর কথা ছিল। অথচ এক্ষেত্রে কোনো কেসিং পাইপ বসানো হয়নি। নদীর পানি কমে গেলে নৌযানের সঙ্গে মূল পাইপ লেগে যায়। কেসিং পাইপ না দেওয়ায় ঝুঁকিতে পড়েছে পুরো প্রকল্প। যশলদিয়া থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত পাইপলাইন বসানো হলেও ঢাকায় পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক প্রস্তুত করা হয়নি। ফলে নগরবাসী কবে নাগাদ পদ্মার পানি পাবেন তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। প্রকল্পের ধাপে ধাপেই এই গলদ। রাজধানীর বাবুবাজারের কাছে সায়েদাবাদ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের সরবরাহ নেটওয়ার্ক রয়েছে। এর ব্যাস ৬০০ মিলিমিটার। কিন্তু যশলদিয়া থেকে যে পাইপ ঢাকায় আসছে এর ব্যস ২ হাজার মিলিমিটার। তাই ৬০০ মিলিমিটারের ব্যাসে যশলদিয়া থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় পানি এনে সরবরাহ করা কারিগরিভাবে সম্ভব হবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এরকম ধাপে ধাপে লুটপাট অনিয়মে প্রকল্প চালু করতে না পারলেও গত বছরের নভেম্বরেই পরিশোধ করা হয়েছে ঠিকাদারের ৯০ শতাংশ বিল। শুধু পারফরমেন্স গ্যারান্টির (পিজি) ১০ শতাংশ পরিশোধ করা হয়নি। এ প্রকল্পে ঠিকাদারের ১ বছরের ওয়ারেন্টি পিরিয়ডের ৮ মাসই পার হয়েছে। বাকি চার মাসে প্রকল্প চালু না হলেও ঠিকাদারকে এই অর্থও পরিশোধ করতে হবে। পরবর্তীতে প্রকল্পে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি তৈরি হলে ঠিকাদারের কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না।

এ প্রকল্পে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে মেসার্স চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। এদের সঙ্গে স্থানীয় ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে অ্যারিডড গ্রুপের পরিচালক আজিজুল আকিল ডেভিড। তবে ডেভিড দাবি করেছেন তিনি স্থানীয় ঠিকাদার নন, চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির কারিগরি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। পাইপের ব্যাপারে আজিজুল আকিল ডেভিড বলেন, ‘ওয়াসা এই পাইপ না নিলে তো আর প্রকল্পে ব্যবহৃত হয়নি। আর বুয়েটের কি সক্ষমতা আছে এই পাইপ টেস্ট করার?’ প্রকল্প হস্তান্তরের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই প্রকল্প জানুয়ারি মাসে শেষ হয়েছে। এ বছর ওয়ারেন্টি পিরিয়ড রয়েছে। এর পরে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সে দায় চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নয়।’

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, পদ্মা (যশলদিয়া) ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের ব্যয় ৩ হাজার ৫০৮ কোটি ৭৯ লাখ ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ২ হাজার ৪২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা ঋণ হিসেবে দেয় চায়না এক্সিম ব্যাংক। বাকি অর্থ দেয় বাংলাদেশ সরকার ও ঢাকা ওয়াসা। ঋণের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংককে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে আবার এ প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা করা হয়। ঋণের শর্তানুযায়ী চায়নিজ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এবং প্রকল্পে ব্যবহৃত পাইপ চীন থেকে আমদানির শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়। সরেজমিন যশলদিয়া প্রকল্প এলাকায় দেখা যায়, বন্ধ রয়েছে পানি পরিশোধন প্রকল্প। পদ্মার পানি টেনে পাম্পে নিয়ে যাওয়ার চ্যানেলেও পানি স্থির। পাম্পের পাশের বাসিন্দা নূর মাতবর বলেন, তিন মাস আগে পাম্প একবার চালু করেছিল। কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট শব্দে পাইপ ফেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে পাম্প বন্ধ হয়ে যায়। পাম্প থেকে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের দূরত্ব প্রায় ৪০০ গজ। এর মাঝে বেপারিবাড়ি মোড়ে পাইপ ফেটে পানি উপরে উঠতে থাকে। যশলদিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আক্কাছ মাতবর বলেন, ‘ওয়াসার এ প্রকল্পে যে ভবন বানানো হয়েছে তাও ফেটে গিয়েছিল। মাসদুয়েক আগে সিমেন্ট দিয়ে তা মেরামত করা হয়। এই পাইপ বসানোর জন্য রাস্তা কেটে জনদুর্ভোগ তৈরি করেছে। এখন সে পাইপও ফেটে যাচ্ছে।’

চুক্তি মোতাবেক ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরির কাজে আরসিসি পাইল করার কথা থাকলেও ঠিকাদার এসএফজি পাইল করেছেন। নিম্নমানের পাইলিংয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম দেশের বাইরে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। উপ-প্রকল্প পরিচালক মিহির কুমার দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের অফিস অর্ডার রয়েছে, আমি কোনো রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলতে পারব না। আপনারা প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’

এমজে/