যাচাই ছাড়াই ১৩ হাজার কোটি প্রাণিজ টিকা আমদানি

তিন হাজার ৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রের ক্ষতি

তিন হাজার ৫ কোটি টাকা রাষ্ট্রের ক্ষতি

দেশে প্রাণিরোগের জন্য গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৩ হাজার কোটি ভ্যাকসিন আমদানি করা হয়। গুণগত মান ও কার্যকারিতা যাচাই না করে আমদানির কারণে দেশের তিন হাজার ৫ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এমনকি আমদানিকৃত ভ্যাকসিন যাচাই করার মতো ল্যাবরেটরিক্যাল কোনো যন্ত্রপাতিও দেশে নেই। তা সত্ত্বেও তিন হাজার কোটি টাকার ভ্যাকসিন দেশে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। অন্য দিকে, ক্ষুরারোগের কারণে দেশে বছরে ৮১৯ কোটি টাকার এবং গোটপ্লেগ রোগের কারণে প্রায় এক হাজার ৮৪২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতির ব্যাপারে পরিকল্পনা কমিশন বলছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কথা, আর প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কোনো বক্তব্য চেষ্টা করেও জানা যায়নি।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, পিপিআর বা গোটপ্লেগ, এফএমডি বা ক্ষুরারোগ, এনথ্রাক্স, জলাতঙ্ক, সালমোনিয়া, রানীক্ষেতসহ অন্যান্য জুনোসিস ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে টিকা বা ভ্যাকসিন আমদানি করা হয়। যার মান ও কার্যকারিতা যাচাই করার কোনো মানসম্পন্ন প্রাণী গবেষণাগার দেশে নেই। যার কারণে আমদানিকৃত এসব টিকার গুণগত মান ও কার্যকারিতা যাচাই করা যায় না। তা সত্ত্বেও শুধু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর প্রায় ১৩ হাজার কোটি ডোজ বিভিন্ন টিকা বা ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি প্রদান করে। বিদেশ থেকে প্রতি ডোজ আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের দর ছিল ২৫ পয়সা। ফলে ১৩ হাজার কোটি ডোজের মূল্য হলো ৩ হাজার ৫ কোটি টাকা। কিন্তু এসব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাই না করে আমদানি করা হচ্ছে। এতে ভ্যাকসিন প্রদানের পরও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলে খামারিরা একদিকে প্রতারিত হন। অন্য দিকে আর্থিক ক্ষতি সম্মুখীন হন। ফলশ্রুতিতে দেশে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ব্যাহত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এখন এসব পরীক্ষা করার জন্য ল্যাব, যন্ত্রপাতি, গবেষণার জন্য নতুন করে ১৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, গঙ্গা-ব্রহ্মহ্মপুত্র অববাহিকায় অবস্থিত এবং ভারত ও মিয়ানমারের দ্বারা তিন দিকে পরিবেষ্টিত। ভৌগোলিকভাবেই বাংলাদেশ বিশ্বে রোগজীবাণুর একটি হট-স্পট হিসেবে বিবেচিত। ফলে আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ এবং জুনোটিক রোগের প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধির পথে একটি অন্যতম অন্তরায়। ক্ষুরারোগ, পিপিআর বা গোটপ্লেট রোগ, রানীক্ষেত রোগ, সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয় এদেশের প্রাণিসম্পদ।

প্রাণিসম্পদ অধিদতরের সূত্র বলছে, স্থির মূল্যে গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান প্রায় ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তা ছাড়া একই অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদিত কাঁচা ও প্রক্রিয়াজত পণ্য রফতানি আয় ছিল প্রায় ৪ হাজার ৩১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। প্রাণিসম্পদ খাতের ভিশন হচ্ছে, দেশে নিরাপদ দুধ, গোশত, ডিম উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় আমিষের চাহিদা পূরণপূর্বক মেধাবী, স্বাস্থ্যবান ও বুদ্ধিদীপ্ত জাতি গঠন করা। আলোচ্য অর্থবছরে ৪০ কোটি ২৫ লাখ ৬৩ হাজার পশুপাখি থেকে ৯৯ লাখ ২৩ হাজার মেট্রিকটন দুধ, সোয়া ৭৫ লাখ মেট্রিক টন গোশত এবং এক হাজার ৭১১ কোটি ডিম পাওয়া গেছে।

বিএলআরআইয়ের তথ্যানুযায়ী, ক্ষুরারোগ দ্রুত সংক্রমণে সক্ষম রোগ। বর্তমানে বাংলাদেশে এই রোগ সমগ্র দেশে সারা বছরই লেগেই থাকে। কেবলমাত্র এই রোগের কারণে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৮১৯ কোটি টাকা। পিপিআর বা গোটপ্লেগ ছাগল ও ভেড়াতে সারা বছরই দেখা যায়। সংক্রমিত অঞ্চলে এই রোগে আক্রান্তের হার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। আর মৃত্যুর হার ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ। এই রোগের কারণে বার্ষিক ক্ষতি প্রায় এক হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। বাংলাদেশে ২০০৭ সালে প্রথম উচ্চমাত্রায় আক্রান্ত ক্ষমতাসম্পন্ন এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা শনাক্তকরণের পর পোলট্রিতে ৫১৯টি প্রাদুর্ভাবের ঘটনা ঘটে। পোলট্রি শিল্পে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় পাঁচ হাজার ১৭২ কোটি টাকা।

আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: হীরণ রঞ্জন ভৌমিকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, পরিকল্পনা কমিশনের কার্যপত্রে যা বলা হয়েছে তা ভুল। কারণ আমরা ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দেই না। এটা অনুমতি দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। দ্বিতীয়ত: হলো বেসরকারিভাবে যেসব ওষুধ আসে বা ভ্যাকসিন আমদানি করা হয় সেগুলোরও অনুমতি ও যাচাই করার দায়িত্ব তাদেরই। তিনি বলেন, আমদানিকৃত ভ্যাকসিন কার্যকর না হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ থাকে। তার মধ্যে একটি হলো, যেসব ভ্যাকসিন আমদানি করা হয়েছিল তা যদি আমাদের দেশের যে রোগের জন্য আমদানি করা হয়েছিল সেই রোগের জীবাণুর সাথে ম্যাচ না করে তাহলে তা কার্যকর হবে না।

পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি ও পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য মো: জাকির হোসেন আকন্দের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, ভ্যাকসিনের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। আমদানিকৃত ভ্যাকসিন যাচাই করার মতো কোনো যন্ত্র আমাদের দেশে নেই। যার কারণে তখন আমদানি করা ভ্যাকসিনগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা যায়নি। তিনি বলেন, এই ভ্যাকসিন পরীক্ষার বায়োটেকনোলজিক্যাল যন্ত্রটির মূল্য হলো ৮ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত প্রকল্পের মাধ্যমে এই যন্ত্রটি আমদানি করা হবে।

এমজে/