প্রভাবশালীদের পেটে রেলের জমি

প্রভাবশালীদের পেটে রেলের জমি

রেলের জমি অবৈধভাবে দখল নতুন কিছু নয়। সুযোগসন্ধানীরা যখন যেভাবে পারছে দখল করে নিচ্ছে। বহুমূল্যের জমি রাজনৈতিক প্রভাবে নামমাত্র মূল্যে লিজ নেওয়া; কৃষিজমি দেখিয়ে লিজের পর বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা-ধর্মীয় ও সেবা-পরিষেবামূলক প্রতিষ্ঠানের লিজ নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ।

এসব জমির অধিকাংশই পরবর্তী সময়ে আর উদ্ধার করতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে মামলাজনিত কারণে বেহাত হওয়া সম্পত্তি উদ্ধার কঠিন হয়ে গেছে। গত ১০ বছরে ১ হাজার ১৮৫ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেগুলোরও একটি বড় অংশ ফের বেদখলে চলে গেছে।

এমনও দেখা গেছে, রেলের জমি দখল করছে প্রভাবশালী ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এর পর ওই জমিতে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে দোকান, ক্লাব, বাসাবাড়ি বানিয়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এসব স্থানে মাদক কারবারসহ অসামাজিক কার্যকলাপও হয়ে থাকে।

রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় রেলের জমির দশা এমনই হয়েছে। দখলকৃত এসব জমিতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, মাদকের কারবার ছাড়াও অসামাজিক কার্যকলাপের জেরে রেলওয়ে কলোনির স্টাফরাও নিরাপদে থাকতে পারছেন না তাদের কোয়ার্টারে। এ দশা থেকে পরিত্রাণের জন্য গত মঙ্গল ও বুধবার অভিযান চলে কলোনিতে। দুদিনে প্রায় ৬৫০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। গতকালও ফের অভিযান চলে সেখানে। এদিন ৭০০ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।

এ বিষয়ে বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, অভিযান চালিয়ে কথিত মাজার, দোকান, পাকা বাড়ি, ক্লাব, ক্যাসিনোর ঘরসহ নানা ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে। পুনরায় যাতে দখল করতে না পারে, সে জন্য কড়া নজরদারি রাখা হচ্ছে।

রেল সূত্র জানায়, বর্তমানে রেলের ৩ হাজার ৮৪১ একর জমি অবৈধ দখলে গেছে। সরকারদলীয় পরিচয়ে জমি দখল করার প্রবণতা বেড়েছে ১৯৯১ সালের পর থেকে। এর পর গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এর কিছু অংশ দখলমুক্ত করা হলেও বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর এসব জমি আবার চলে যায় অবৈধ দখলে। জমি দখলমুক্ত করতে অভিযান পরিচালনা করেও ব্যর্থ হয় রেলের সম্পত্তি বিভাগ।

এ সংক্রান্ত নথি ঘেঁটে দেখা গেছে, ১৯৯১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ১৩ হাজার একরেরও বেশি জমির ইজারা নিয়েছেন যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয়েছে, সে দলের নেতাকর্মীরা। মামলার কারণে বেহাত সম্পত্তি উদ্ধারে যে আইনি লড়াই প্রয়োজন, অর্থাভাবে সেটিও চালাতে পারে না রেল কর্তৃপক্ষ। ফলে অধিকাংশ মামলার লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

ফলে রেলেরই একশ্রেণির কর্মকর্তার যোগসাজশে জমি দখল করে আদালতে উল্টো মামলা ঠুকে দেওয়ার কৌশল নিয়েছে অবৈধ দখলদাররা। রেলের বেদখল জমি উদ্ধারে শক্তিশালী আইনি লড়াই প্রয়োজন। তাই এ খাতে বাজেট বৃদ্ধিরও সুপারিশ করেছে রেলওয়ের সম্পত্তি বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নামমাত্র মূল্যে কৃষিজমি লিজ নিয়ে দোকানসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার ঘটনা রেলে অহরহ। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় রয়েছে ৫৬ দখলবাজ। তাদের প্রত্যেকেই কৃষিজমি বা পুকুরের অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করছেন রেলের জমি। তাদের অবৈধভাবে ব্যবহৃত জমির পরিমাণও কম নয়Ñ ২৩.৮৮ একর। বর্গফুট হিসাবে তা ২ লাখ ৫ হাজার ৭৪১ বর্গফুট। এসব কা- ঘটেছে সিলেট, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, মৌলভীবাজার ও জামালপুরে।

রেলওয়ের সূত্রমতে, বর্তমানে ৬১ হাজার ৮৬০ একর জমি রয়েছে। এর মধ্যে অপারেশনাল কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩১ হাজার ৫৬৮ একর। গত ১০ বছরে রেলের পূর্বাঞ্চলে ৬১৯ একর ও পশ্চিমাঞ্চলে ৫৬৬ একর জমি অভিযানের মাধ্যমে দখলমুক্ত করা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এর বেশিরভাগই ফের চলে যায় দখলবাজদের কব্জায়। এবার অভিযান চালিয়ে জমি দখলমুক্ত করার পর ফের যেন বেদখল না হয়ে যায়, সে জন্য রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন কঠোর দৃষ্টি রাখার নির্দেশ দিয়েছেন মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের। মন্ত্রী বলেছেন, অভিযানে উদ্ধার হওয়া জমি যেন যথাযথ তদারকি করা হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কেবল রাজনৈতিক পরিচয়যুক্ত ব্যক্তিবিশেষই নয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও রেলের জমি বেদখলের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে সরকারি, আধা সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের দখলে ৯২২ একর, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ২৮২৮ একর এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নামে গেছে ৯০ একর জমি। এরও বাইরে ১৪ হাজার ৪৭৩ একর জমি ব্যবহৃত হচ্ছে লিজে। এসব জমি বাণিজ্যিক, কৃষি, মৎস্য, নার্সারি/বনায়ন, সিএনজি স্টেশন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পিডিবি, সান্তাহার সাইলো ও খুলনা ওয়াসার নামে লিজ নিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। সুত্র: দৈনিক আমাদের সময়।