বিদেশে অর্থ পাচারের ১২৮ ঘটনা শনাক্ত

বিদেশে অর্থ পাচারের ১২৮ ঘটনা শনাক্ত

বিদেশে অর্থ পাচারে ১২৮টি লেনদেনের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৮টি ঘটনায় মামলার পর শুরু হয়েছে তদন্ত কার্যক্রম। বাকি একশ’টি লেনদেনের ঘটনার ওপর নজরদারি করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। প্রমাণ সাপেক্ষে এসব লেনদেনের ঘটনা নিয়ে পরবর্তী আইন ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সম্প্রতি ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ’ সংক্রান্ত সরকারের ওয়ার্কিং কমিটির ১৫তম বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বৈঠকে অর্থ পাচার নিয়ে করা বড় মামলাগুলোর তদন্ত দ্রুত শেষ করতে সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এজেন্সিকে নির্দেশ দিয়েছে ওয়ার্কিং কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অর্থ পাচার প্রতিরোধে সরকার বড় ধরনের পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির সভা ডাকার দিনক্ষণ চেয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম ওই সারসংক্ষেপে বলেছেন, জাতীয় সমন্বয় কমিটির ২৩তম বৈঠকে জাতীয় কৌশলপত্রের (২০১৯-২০২২) খসড়া অনুমোদন হয়েছে। এছাড়া বৈঠকে অপরাধের বিষয়ে পারস্পরিক সমন্বয় আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় সংস্থা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক উইং খোলারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি নগদ লেনদেন হ্রাস নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ, জমি রেজিস্ট্রেশনে বাজারভিত্তিক লেনদেন পদ্ধতি, বিদেশিদের ভিসার ধরন পরিবর্তন করে চাকরির ক্ষেত্রে কর আদায়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন সংক্রান্ত মামলা ও বিটকয়েনসহ অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগের বৈঠকের এসব সিদ্ধান্তের অগ্রগতি জানা দরকার। জানা গেছে, অর্থমন্ত্রীর সম্মতি পেলেই বৈঠকের দিনক্ষণ ঠিক করবে কমিটি। সহসাই এ বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে জানান, অনেক ব্যাংক লেনদেনকে সন্দেহজনক আওতায় এনে অধিক তদন্তের জন্য পাঠানো হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে। তদন্তকালে বড় ধরনের কোনো ঘটনা পাওয়া গেলে তথ্যপ্রমাণসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এছাড়া দেশের বাইরে কোনো ঘটনায় জড়িত থাকলে বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসের সহায়তায় তদন্ত হয়। এ কাজই করছে বিএফআইইউ। সূত্র মতে, বিভিন্নভাবে বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ে ইতিমধ্যেই সরকারের একাধিক এজেন্সি ৩৩টি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। পরে এগুলো দাখিল করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসহ বিএফআইইউ-তে। অধিকতর তদন্তের জন্য বিএফআইইউ এসব প্রতিবেদন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠায়।

‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা, নীতি প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয় কমিটির’ সাম্প্রতিক বৈঠকে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সরকারের এজেন্সির রিপোর্টের ভিত্তিতে মানি লন্ডারিং নিয়ে ১০টি মামলা হয়েছে। আরও একশ’ লেনদেন নজরদারির আওতায় রয়েছে, তদন্ত চলছে ১৯টির। এ পর্যন্ত ৩৩টি মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনায় সাজা হয়েছে।

ঐ বৈঠকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং নিয়ে তারা ১৭টি মামলা করেছে। ৩টির তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং নিয়ে তাদের একটি মামলার তদন্ত চলছে। ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির’ সভাপতি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র সচিব আসাদুল ইসলাম বলেন, অর্থ পাচার মামলার তদন্ত দীর্ঘদিন চললে বিদেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সম্পদ জব্দ রাখা এবং অর্থ ফেরত আনায় জটিলতা সৃষ্টি হয়। তিনি অর্থ পাচার রোধে সম্ভাব্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করতে বিএফআইইউকে পরামর্শ দিয়েছেন। ওই বৈঠকে অর্থ পাচার নিয়ে বিএফআইইউ’র পাঠানো বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্ট এবং এ সংক্রান্ত মামলার অগ্রগতি পর্যালোচনায় সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিএফআইইউ’র সঙ্গে নিয়মিত বৈঠকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে চার প্রক্রিয়ায় ৫৯০ কোটি ডলার (৫০ হাজার কোটি টাকা) পাচার হয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশের চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের চেয়েও বেশি। বছরে পাচার হয়েছে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা। টাকা পাচারে বিশ্বের শীর্ষ ৩০ দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশ।

সূত্র বলছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালেই বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি একটি অর্থ পাচারের ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, চীন থেকে প্রতি পিস টাকার উত্তোলন মেশিন (এটিএম) কেনা হয় ৩ হাজার ৫৭০ মার্কিন ডলারে। কিন্তু এলসিতে এর আমদানি মূল্য ঘোষণা দেয়া হয় ১১শ ডলার। একইভাবে সিআরএস (টাকা উত্তোলন ও জমা মেশিন) প্রতি পিস ১২ হাজার ৫৫০ ডলারে কিনলেও এলসি মূল্য দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৫শ’ ডলার। সম্প্রতি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জামান টেকনোলজি লিমিটেড আন্তর্জাতিক ট্রেডিংয়ের নামে বড় ধরনের এই শুল্ক ফাঁকি দেয়। পাশাপশি এ কৌশলে অর্থ পাচারও করে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশ দেয়া হয়। এনবিআর বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।

এমজে/