নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ আরইবি

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে ব্যর্থ আরইবি

দেশের কোথাও শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারছে না পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। শিল্পের জন্য কোয়ালিটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা তো দূরের কথা গ্রামাঞ্চলেও আরইবির লোডশেডিং এখন চরমে।

প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে বিদ্যুৎ নিয়ে বহু শিল্প মালিক ধরাশায়ী। যাদের কেউ কেউ মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ে দেখা করে বলেছেন, আমাকে বাঁচান। আরইবির বিদ্যুৎ নিয়ে শিল্প চালানো তো দূরের কথা অব্যাহত লাইন ট্রিপের কবলে পড়ে যন্ত্রপাতি সব অকেজো হয়ে যাচ্ছে।

এভাবে চলতে থাকলে ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে হবে। এভাবে বহু শিল্পোদ্যোক্তা চরম ক্ষতির সম্মুখীন। কিন্তু এটি মানতে নারাজ আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন। বরং প্রতিকার চাইতে গেলে তিনি কাউকে পাত্তা দেন না। অগত্যা ভুক্তভোগীদের ভোগান্তির শেষ নেই।

এদিকে বিশ্লেষকদের কয়েকজন জানিয়েছেন, সরকার শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড গড়ে বাহাবা নিতে চাইছে। কিন্তু সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন আধুনিকায়নে নজর নেই। এর ফলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অপচয় বা নষ্ট হচ্ছে। কারণ বিদ্যুৎ তো সঞ্চয় করে রাখা যায় না।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন শিল্পপতি তাদের শিল্পকারখানায় প্রতিদিন কতবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে এবং তাতে বিপুল অঙ্কের ক্ষতির বিষয়টি আরইবির নজরে এনে প্রতিকার দাবি করেন। এর মধ্যে আরইবি সূত্রে প্রাপ্ত একজন ভুক্তভোগীর প্রদত্ত তথ্যে দেখা গেছে, তার একটি কারখানায় একবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটলে ৫২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়।

এই হিসাবে তার ৫টি কারখানায় একবার বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলে তিনি ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার আর্থির ক্ষতির সম্মুখীন হন। কারণ একবার বিদ্যুৎ গেলে কারখানার অত্যাধুনিক কম্পিউটারাইজ ও প্রোডাকশন লাইন ব্যাচ ওয়াইজ হওয়ায় প্রতিটি কারখানা পরবর্তী উৎপাদনে যেতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা সময় লাগে।

এতে ওই ব্যাচটির সম্পূর্ণ মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। যার মূল্য প্রতি ঘণ্টায় ২৬ লাখ টাকা করে ২ ঘণ্টায় ৫২ লাখ টাকা। এ ছাড়া কম্পিউটারাইজ মেশিনারিজগুলো চালু অবস্থায় হঠাৎ বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে বন্ধ হলে সফটওয়্যার সিস্টেমও নষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেড়ে যায়।

ওই ব্যবসায়ী আরইবিকে আরও বলেন, তার কারখানায় দুই মাসে ২৩ বার লাইন ট্রিপ করেছে। এখন আরও বেড়ে গেছে। এভাবে প্রতিমাসে বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনা ঘটছে দেশের প্রতিটি শিল্পকারখানায়। এ অবস্থায় আরইবির বিদ্যুৎ ব্যবহার করে শিল্প মালিকরা বড় ধরনের বেকায়দায় পড়েছেন।

অথচ আরইবি চেয়ারম্যান ওই চিঠি পেয়ে কোনো পাত্তাই দেননি। উল্টো বলেছেন, কারিগরি ত্রুটি, ট্রান্সফরমার ট্রিপ, মেরামতের জন্য ওই সময়ে মাত্র ১০৬ মিনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। অপর একজন শিল্পপতি বলেন, তার কারখানায় বছরে ১৯২ বার বিদ্যুৎ ট্রিপ করে।

এভাবে ক্ষতির হিসাব কষলে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হবে। ফলে লাভ কীভাবে করবে, পুঁজি নিয়েই টানাটানি অবস্থা। বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সরকার পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) প্রতিষ্ঠা করেছিল গ্রামের বাড়িঘর, আলোকিত করার জন্য।

পাশাপাশি গ্রামের সর্বোচ্চ ২-৩ মেগাওয়াট চাহিদার ছোট ছোট কুটির শিল্পে বিদ্যুৎ দেয়ার জন্যই মূলত আরইবির জন্ম হয়েছিল। শিল্পকারখানার চাকা ঘুরানোর দায়িত্ব আরইবির নয়। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর একটি সিন্ডিকেট নিজেদের আয় বাড়ানোর জন্য গ্রামের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ না দিয়ে শিল্পকারখানায় বিদ্যুৎ দেয়া শুরু করে।

যেসব শিল্পকারখানায় ১০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ চাহিদা সেখানেও আরইবি বিদ্যুৎ দিতে শুরু করে। যার কারণে পুরো দেশের শিল্পকারখানায় বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। শিল্পে সর্বত্র বিশৃঙ্খল অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। এখন বিদ্যুৎ দিতেও, আবার ব্যর্থতাও স্বীকার করছে না। এটি তো ভয়াবহ। জিম্মি করে রাখা।

কিন্তু দেশে শিল্পবিপ্লবে ব্যবসায়ীদের দেয়া প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হলে আরইবিকে তার অবস্থান পরিবর্তন করতেই হবে। তা না হলে প্রকারান্তরে প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। এ ছাড়া ব্যবসার তো বারোটা বাজবেই।

সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এ সভায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, আমাদের প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, অধিকাংশ সময় ব্যবসায়ীরা সেই বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। দিনে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা অধিকাংশ জায়গায় বিদ্যুৎ থাকে না।

এতে তাদের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক জায়গায় আরও বেশি সমস্যা আছে। এসব সমস্যা সমাধানে দ্রুত একটি স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। যদি ব্যবসায়ীরা ইফিশিয়েন্ট ওয়েতে এনার্জি ব্যবহারের মাধ্যমে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র করে তাহলে আমরা সেগুলো চালু রাখব। সেসব ক্যাপটিভে ২৪ ঘণ্টা গ্যাস দেব।

মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, শিল্পে যে ধরনের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, তা নিরবচ্ছিন্ন ও কোয়ালিটিসম্পন্ন নয়। ভোল্টেজ আপ-ডাউন ও লোডশেডিংয়ের কারণে কারখানায় সেই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ রফতানি কাজে ব্যবহৃত মেশিনগুলো খুবই সংবেদনশীল। ভোল্টেজ আপ-ডাউনের কারণে অনেক ডিভাইস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি মেশিনে ব্যবহৃত কোটি কোটি টাকার কাঁচামাল নষ্ট হচ্ছে।

আরইবির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন তার কার্যালয়ে দাবি করেন, পৃথিবীর কোনো দেশ নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। বাংলাদেশেও দেয়া সম্ভব নয়। তার মতে, গ্রামের কোথায় লোডশেডিং নেই। শত শত উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে আরইবি। এ সফলতার কারণে সরকার তাকে আরইবির চেয়ারম্যান করে রেখেছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিয়ে এ সংকট দেশের শিল্পকারখানার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যেনতেন ছুতোয় বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটিয়ে দেশের অগ্রসরমান শিল্পের লাগাম টেনে ধরা এ ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্য। ভুক্তভোগী ও বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে একটি চক্র দীর্ঘদিন থেকে দেশের স্বার্থবিরোধী এ ধরনের কাজে যুক্ত।

যারা আগে বিদ্যুৎ ঘাটতির অজুহাতে নানা টালবাহানা করত, এখন প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জিত হলেও তারা নতুন করে এ সেক্টর নিয়ে ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতেছে। ফলে বেসরকারি খাতে সরকারের বিনিয়োগ নীতি সহায়তা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া শিল্পোদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের ক্ষতি তো সীমাহীন। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেয়ে অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বিদ্যুতের ৩৩ কেভি সঞ্চালন লাইনে চরম বিদ্যুৎ বিভ্রাট হচ্ছে। এ লাইনেও প্রতিদিন গড়ে ২-৩ বার বিদ্যুৎ যাচ্ছে। গাছের ডালপালার আঘাত এমনকি ছোটখাটো পাখির ঝাপটায়ও ট্রিপ করছে (গ্রিড স্টেশনের সার্কিট পড়ে যাওয়া) গ্রিডলাইন। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে এমনকি ঝড় শুরুর আগেই রহস্যজনক কারণে সুইচ অফ করে দিচ্ছে লাইনের। আবার কিছুদিন পরপর মেইনটেন্যান্সের কথা বলে ২-৩ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলছেন, ৩৩ কেভি লাইনের বেশিরভাগ গ্রাহকই শিল্প-কলকারখানার। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা পেতে তারা এ লাইন থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে। অথচ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) কোনো মাথাব্যথা নেই।

তাদের এই অহেতুক বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে শিল্প-কলকারখানার অত্যাধুনিক মেশিনারিজগুলোর সিস্টেম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। দফায় দফায় বিদ্যুৎ ট্রিপ করায় অনেক প্রতিষ্ঠানে পুরো মেশিনারিজ সিস্টেম অকেজো হওয়ার পথে। নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কেমিক্যাল। সূত্র : যুগান্তর

এমজে/