সাধারণ নাগরিককে ফাঁসিয়ে দিয়ে পয়েন্ট অর্জন

পুলিশের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা পুরস্কারে পয়েন্ট গলদ

পুলিশের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা পুরস্কারে পয়েন্ট গলদ

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্রাইম জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের তিনটি ক্যাটাগরিতে ১৫ পয়েন্টের ভিত্তিতে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা বাছাই করা হয়। এর মধ্যে মামলা নিষ্পত্তিতে ৫ পয়েন্ট, থানার পারফরম্যান্সের ওপর ৫ পয়েন্ট এবং কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সাফল্যের জন্য ৫ পয়েন্ট নির্ধারিত।

ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিটের প্রায় ১৫ এসি পদমর্যাদার কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, ওই তিনটি ক্যাটাগরি ভালো কাজের সঠিক মূল্যায়নের জন্য যথেষ্ট নয়। কারণ এতে ঘুরেফিরে অপরাধপ্রবণ জোনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারাই এই পুরস্কার পেয়ে যাচ্ছেন। উদাহরণ হিসেবে তারা মিরপুর, পল্লবী, ডেমরা, লালবাগ, শ্যামপুরের মতো ক্রাইম জোন এবং উত্তরা ও রামপুরার মতো ট্রাফিক জোনের কথা উল্লেখ করেছেন।

ডিএমপির শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা বাছাই প্রক্রিয়ার বিদ্যমান পয়েন্ট সিস্টেমকে ত্রুটিপূর্ণ বলছেন ডিএমপির বিভিন্ন পর্যায়ের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই। এই পয়েন্ট অর্জনে কিছু কিছু পুলিশ কর্মকর্তা সেবা প্রদানের চেয়ে মানুষের হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছেন বলেও পুলিশ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ মনে করেন। কিছু ক্ষেত্রে অনৈতিকভাবে সাধারণ নাগরিককে ফাঁসিয়ে দিয়েও পয়েন্ট অর্জনের ঘটনার কথাও জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এ ছাড়া ‘নন-অপারেশনাল’ শাখায় কর্মরতদের পুরস্কার পাওয়ার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। অথচ কর্মকর্তারা বলছেন, চাইলে যে কোনো পদে থেকেই পুরস্কার পাওয়ার মতো ভালো ও গ্রহণযোগ্য কাজ করার সুযোগ রয়েছে।

বেশিরভাগ কর্মকর্তা বলছেন, পয়েন্ট ব্যবস্থার পরিবর্তে ইউনিটভিত্তিক সেরা কর্মকর্তা মনোনয়ন দেওয়া হলে সমস্যার সমাধান হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক ইউনিটপ্রধান তার সেরা কর্মীর নাম প্রস্তাব করবেন ডিএমপি কমিশনারের কাছে।

নৈতিকতা, জনসম্পৃক্ত পুলিশিং, সাহসিকতা ও পেশাগত মনোন্নয়নসহ বেশ কিছু বিষয় সামনে রেখে কর্মকর্তা-সদস্যদের উৎসাহ প্রদানের লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তাদের পুরস্কৃত করে আসছে ডিএমপি। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্যাটাগরিতেই পয়েন্টের ভিত্তিতে ডিএমপির কনস্টেবল থেকে উপকমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের এই পুরস্কার প্রতিমাসে প্রদান করা হয়ে থাকে। পুরস্কার হিসেবে সনদ ও আর্থিক সম্মানী দেওয়া হয়। পয়েন্ট ছাড়াও বিশেষ ক্যাটাগরিতে জঙ্গি ও ডাকাত গ্রেপ্তার, মাদকের বড় চালান উদ্ধারসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা বাছাই করা হয়ে থাকে।

ডিএমপির মুখপাত্র ডিসি মো. মাসুদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট মানদ- অনুসরণ করে পুরস্কারের জন্য শ্রেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা নির্বাচন করা হয়। এর ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ নেই।

ডিএমপির সিনিয়র এক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, রাজধানীর একটি গুরুত্বপূর্ণ থানার ওসি এ বছর বেশ কয়েকবার শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার পুরস্কার পেয়েছেন। এমনও দেখা গেছে, একজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করে ওই থানাপুলিশ; কিন্তু তার কাছে কোনো মাদক পাওয়া যায়নি। পুরস্কার পাওয়ার জন্য তাকে গাঁজা দিয়ে গ্রেপ্তার দেখান ওই ওসি। কারণ মাদক উদ্ধারে পয়েন্ট বেশি। এভাবেই ওই মাসের শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার পুরস্কার নিয়ে নেন নিজের ঝুলিতে। অথচ থানায় মানুষ কতটা সেবা পান তা নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না।

বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুত্রে গেছে, আদালত থেকে পাঠানো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সাধারণত এসআইদের তামিলের কথা। কিন্তু এর ক্রেডিট অনেক ক্ষেত্রে এসি পদমর্যাদার কর্মকর্তারা পর্যন্ত নিচ্ছেন শুধু পয়েন্ট বাড়ানোর জন্য।

পুরান ঢাকার লালবাগ ও চকবাজার থানা এবং লালবাগ ক্রাইম ডিভিশনের কর্মকর্তারা প্রায় নিয়মিতই শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার পুরস্কার পাচ্ছেন। বিস্ফোরক উদ্ধারে পয়েন্ট বেশি। ওই দুটি থানা এলাকায় আতশবাজিসহ বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক বিক্রি হয় সবচেয়ে বেশি। এসব বিস্ফোরক জাতীয় দ্রব্য জব্দ দেখিয়ে নিয়মিত পুরস্কার পাচ্ছেন থানাগুলোর কর্মকর্তারা। এই ক্রাইম ডিভিশনে ১২ বার শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার পুরস্কার পাওয়া এক ডিসির বিরুদ্ধে নানা ধরনের শৃঙ্খলাপরিপন্থী কাজে যুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের একটি ক্রাইম জোনের এসি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘টানা ষষ্ঠবারের মতো শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার পুরস্কার পেলাম’। জানা গেছে, ওই জোনে দায়িত্ব পালনকারী আগের এসিরাও প্রায় নিয়মিত পুরস্কার পেতেন।

তবে নিয়মিত শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তার পুরস্কার পাওয়া কয়েক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা কেউ অন্য কর্মকর্তাদের উত্থাপিত আপত্তির বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। এসি থেকে ডিসি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, পরিদর্শকের ওপরে এসি পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের অন্যতম কাজ সুপারভিশন নোট দেওয়া। এ ছাড়া জিডি ও সিডি (কেস ডায়েরি) তদারকি করা। কিন্তু পয়েন্ট গণনায় এসব কাজ অন্তর্ভূক্ত না থাকায় এগুলো এড়িয়ে যান অনেক কর্মকর্তা। এর পরিবর্তে তারা সহজে পয়েন্ট পাওয়া যায় এমন কাজে অধিক মনোযোগী।

পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে নানা অসঙ্গতির কথা স্বীকার করলেও এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো বক্তব্য দিতে চাননি ডিএমপির শীর্ষ কয়েক কর্মকর্তাও।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে সব এলাকায় অপরাধের ধরন ও মাত্রা এক নয়। এ কারণে শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা নির্বাচনে আরো অনেকগুলো বিষয় নির্ভর করে। ডিএমপির বিদ্যমান মানদণ্ডের সঙ্গে আরো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যুক্ত করতে হবে। সমানভাবে বিচার বিবেচনার অভাবে কোনো কর্মকর্তা মনোক্ষুণ হলে তার কাজের গতি কমে যেতে পারে। সুত্র: দৈনিক আমাদের সময় অনলাইন।

এমআই