আয়করের ৩৬ শতাংশই পাচার, ২০১৬ সালে ৬৫ হাজার কোটি টাকা পাচার

আয়করের ৩৬ শতাংশই পাচার, ২০১৬ সালে ৬৫ হাজার কোটি টাকা পাচার

স্বল্পোন্নত (এলডিসি) ৪৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের হার তুলনামূলক বেশি বলে জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা আংকটাডের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তা ওই বছরের মোট রাজস্ব আদায়ের ৩৬ শতাংশের সমান। পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

বুধবার রাজধানীর পল্টন টাওয়ারে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামে (ইআরএফ) আংকটাডের প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

আংকটাডের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ গত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাফল্য দেখালেও রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে পেছনের সারিতে রয়ে গেছে। রাজস্ব আদায়ে এ পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে ১ নম্বরের দশমিক ৬৭ নম্বর পেয়েছে বাংলাদেশ। কর খাত সংস্কারে ২৯টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ২৭তম। আংকটাড বলছে, রাজস্ব আদায়ে পিছিয়ে পড়ার বড় কারণ হলো অর্থপাচার।

সংস্থাটি বলেছে, রাজস্ব আদায় না বাড়ার কারণে বৈদেশিক ঋণের ওপর ভর বাড়ছে সরকারের। আংকটাডের প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সংস্থাটির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন ও গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আদায় ছিল এক লাখ ৮২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এর ৩৬ শতাংশের মানে ওই বছর দেশ থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে, যা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু করা সম্ভব। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই বছর সবচেয়ে বেশি পাচার হয়েছে কম্বোডিয়া থেকে। দেশটি থেকে পাচারের পরিমাণ মোট করের ১২০ শতাংশের বেশি। আর সবচেয়ে কম পাচার হয়েছে লাওস থেকে, যা ওই দেশের রাজস্বের ১ শতাংশের কম।

আংকটাডের প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সিপিডি বলেছে, দেশের অর্থনীতির অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশে অর্থপাচার। অর্থপাচার বন্ধ হলে বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে।

সিপিডি বলেছে, বাংলাদেশ এরই মধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আগামী ২০২৪ সালে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার কথা রয়েছে। এই দুই উত্তরণের ফলে বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তায় তিনটি প্রভাব পড়তে পারে। প্রথমত, সাশ্রয়ী হারে আগে যেভাবে অর্থ পাওয়া যেত সেটি বন্ধ হবে, রপ্তানিতে বিভিন্ন দেশের বাজার সুবিধা কমবে এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা কমে যাবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিকল্প কী করণীয় তা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।

মূল বক্তব্য উপস্থাপন শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনীতির কাঠামো শক্তিশালী করতে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কর আহরণের বিকল্প নেই। কারণ আমাদের রাজস্ব আদায় না বাড়লে উন্নয়ন সহযোগীরা টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ততটা আগ্রহ দেখাবে না। উন্নত বিশ্ব থেকে একটি কথা বলা হয়—তোমরা যত টাকা দেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারবে, আমরা তত টাকা দেওয়ার জন্য আগ্রহ দেখাব।

দেবপ্রিয় আরো বলেন, সামাজিক খাত ও পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দেশে যে প্রভাব পড়বে, তা মোকাবেলায় অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের যে রপ্তানি আয় হয়, তা বাজার সুবিধার ওপর নির্ভরশীল। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে এলে বিভিন্ন দেশে যে বাজার সুবিধা (জিএসপি) পাওয়া যায়, তা বন্ধ হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কী করা যায়, তা ভাবতে হবে। পাশাপাশি স্বল্পোন্নত দেশে থাকাকালে যে প্রযুক্তি সুবিধা পাওয়া যেত, বন্ধ হলে কী করণীয় সেটি অবশ্যই ভাবতে হবে।

তিনি বলেন, এই সহায়তা অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত জরুরি। অর্থাৎ পরিষদ যদি সিদ্ধান্ত নেয় তারা আগের মতো সহায়তা অব্যাহত রাখবে, তবেই শুধু সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব।

দেবপ্রিয় বলেন, ‘বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক খাতে উন্নতি করছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশ দুটি উত্তরণের পর্যায়ে আছে। এ উত্তরণ অবশ্যই আমাদের অগ্রগতিকে নির্দেশ করে। কিন্তু এর ফলে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো মনে করছে, আমাদের আর্থিক সক্ষমতা বেড়েছে। তাই নিয়মানুযায়ী তারা আমাদের বিভিন্ন ধরনের বৈদেশিক ঋণের সুদ বাড়িয়ে দিচ্ছে। একই সঙ্গে অনুদানের অনুপাত কমছে।’

মূল প্রবন্ধে জানানো হয়, বিশ্বে বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশের সংখ্যা ৪৭। উন্নত দেশগুলো তাদের মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) দশমিক ১৫ থেকে দশমিক ২০ শতাংশ অনুদান হিসেবে স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে দেওয়ার কথা। কিন্তু তারা পূর্ণাঙ্গভাবে তাদের সে প্রতিশ্রুতি পূরণ করছে না। ফলে স্বল্পোন্নত দেশগুলো যে অনুদান পাওয়ার কথা তারা তা পাচ্ছে না। প্রতিশ্রুত টাকা দিতে উন্নত বিশ্বের ওপর চাপ প্রয়োগের পরামর্শও এসেছে প্রবন্ধে।

এমজে/