ইসলামিক ফাউন্ডেশনে দুর্নীতি

ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়

ক্ষমতার অপব্যবহার করে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) কাজে সরকারি বিধিবিধান, নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় ও নানা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়েছে গত ১০ বছরে। এ ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগ, ধর্ম মন্ত্রণালয় ও ইফা বোর্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে অন্তত ২৩টি বড় খাতে ৩০০ কোটি টাকার কার্যক্রম পরিচালনার বিষয় উদঘাটিত হয়েছে সরকারি নিরীক্ষায়।

মন্ত্রণালয় ও ইফা বোর্ডকে না জানিয়ে মহাপরিচালকের (ডিজি) অভিপ্রায়ে ব্যাংকে স্থায়ী আমানত ও পেনশন ফান্ডে অর্থ স্থানান্তর, ব্যাংক হিসাব পরিচালনায় বোর্ডের নির্দেশনা অমান্য, ডিজির একাধিক গাড়ি ব্যবহার, প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও বছরের পর বছর গাড়ি ব্যবহার, অকেজো ঘোষিত গাড়ির মেরামত ও জ্বালানিতে লাখ লাখ টাকা ব্যয়, নগদ ব্যয়ের আর্থিক সীমালঙ্ঘন, এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয়, নিয়মবহির্ভূতভাবে সম্মানী প্রদানের মতো অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

সরকারি নিরীক্ষায় এসব অনিয়মের জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার পাশাপাশি আপত্তিকৃত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যয়োত্তর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেয়ার পক্ষে মত দিয়ে রিপোর্ট চূড়ান্ত করা হয়েছে।

ইফার ২০০৯-২০১৮ সাল পর্যন্ত ১০ বছরের কার্যক্রমের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা চালায় সিভিল অডিট অধিদফতর। এতে ৯৬টি খাতে ৭৯৬ কোটি ৭৮ লাখ টাকার অনিয়ম বেরিয়ে আসে। তার মধ্যে নিয়োগ ও পদোন্নতি এবং ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রেই বেশি অনিয়মের ঘটনা লক্ষণীয়।

বিচারিক কর্মকর্তা সামীম মোহাম্মদ আফজল ২০০৯ সাল থেকে ইফা মহাপরিচালকের (ডিজি) দায়িত্ব পালন করে আসছেন। আগামী ৩১ ডিসেম্বর তার সর্বশেষ চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে। গত ৯ জুলাই থেকে ১০ অক্টোবর পরিচালিত নিরীক্ষার খসড়া রিপোর্টটি গত ২৪ নভেম্বর ধর্ম মন্ত্রণালয়ে অ্যাগ্রিডমিটিংয়ের মাধ্যমে চূড়ান্ত হয়।

বোর্ডের নির্দেশ না মেনে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা এবং ফারমার্স ব্যাংকে ৩০ কোটি টাকা এফডিআর: ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইফা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই ইফা ডিজির নির্দেশনা এবং অভিপ্রায়ে ফারমার্স ব্যাংকে ২৯ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার টাকা স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রাখা হয়। ইফা বোর্ড সর্বশেষ গত ২২/০৬/২০১৯ তারিখে ইফার ব্যাংক হিসাব ডিজি, সচিব ও অর্থ বিভাগের পরিচালকের যৌথ স্বাক্ষরে পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে সাত দিনের মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য কোনো ব্যাংকে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু অডিট চলাকালীন সময় পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, বোর্ডের সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করার এখতিয়ার ডিজির নেই।

নগদ ক্রয়ে ৫ লাখ টাকার স্থলে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা অগ্রিম প্রদান: পিপিআর ২০০৮ এর বিধি অনুসরণ না করে বিধিবহির্ভূতভাবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের নামে অগ্রিম টাকা প্রদান করেন ইফা ডিজি। এর মধ্যে ৩০ জুন ২০১৮ পর্যন্ত ৭৮ লাখ ৩৬ হাজার ১৬৩ টাকা অসমন্বিত রয়ে গেছে। বিধি অনুযায়ী সব ক্রয়কারীর জন্য ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন বাধ্যতামূলক হলেও এ ক্ষেত্রে কোনো ক্রয় পরিকল্পনা করা হয়নি। দাফতরিক প্রাক্কলন প্রস্তুত করা হয়নি এবং সরাসরি ক্রয়ের জন্য বছরে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা নির্ধারিত অথচ অগ্রিম প্রদান করা হয়েছে ১ কোটি ১১ লাখ ২২ হাজার ৩০০ টাকা। অর্থাৎ ১০ কোটি ৬২ লাখ ২ হাজার ৩০০ টাকা বেশি প্রদান করা হয়েছে। ইফার জবাবে বলা হয়, দাফতরিক কাজ তথা সংস্থার বিভিন্ন জরুরি কাজ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে অগ্রিম প্রদানও পর্যায়ক্রমে সমন্বয় একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, বিধি লঙ্ঘন করে এমন অগ্রিম প্রদানের কোনো সুযোগ নেই, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে নিরীক্ষা সুপারিশে।

মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া পেনশন ফান্ডে ১৪১ কোটি টাকা স্থানান্তর: মন্ত্রণালয়, ইফা বোর্ডের অনুমোদন ছাড়া এবং অনুমোদিত বাজেটে পেনশন ফান্ডে অর্থের সংস্থান না থাকা সত্ত্বেও ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪১ কোটি ২৭ লাখ ৭৮ হাজার টাকা পেনশন ফান্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে ইফার জবাবে বলা হয়, কর্মচারী অবসরভাতা তহবিল প্রবিধান মোতাবেক এই টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। নিরীক্ষায় এই জবাব গ্রহণ না করে মন্ত্রণালয়ের ব্যয়োত্তর অনুমোদন গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে।

ডিজি নিজের গাড়ি ছাড়াও প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার: ইফা ডিজির জন্য একটি গাড়ি বরাদ্দ রয়েছে (ঢাকা মেট্রো-গ-২৬-১৪৬৪)। তা সত্ত্বেও তিনি ইসলামিক মিশনের একটি গাড়ি ব্যবহার করেন (ঢাকা মেট্রো-১১-৫৪৩০), যেটির মেরামত ও জ্বালানি বাবদ ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪৪ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনি গাড়ি মেরামত বাবদ ৭৫,০০০ টাকা প্রাপ্য। কিন্তু তিনি নির্ধারিত গাড়ি ছাড়াও অন্য একটি গাড়ি ব্যবহার করে তার ব্যয়ও পরিশোধ করেছেন।

ইফার জবাবে বলা হয়, পরিবহনপুল কর্তৃক আলোচ্য পাজেরোটি ডিজির জন্য বরাদ্দ। নিরীক্ষায় বলা হয়, ডিজির জন্য নির্ধারিত গাড়ি থাকার পর অন্য গাড়ি বরাদ্দের কোনো সুযোগ নেই। এই টাকা পরিশোধ করার পক্ষে মত দেয়া হয়েছে নিরীক্ষায়।

৮ কোটি টাকার জায়গায় ৪৫ কোটি টাকা ব্যয়: ক্ষমতার অপব্যবহার করে ইফা প্রেসের কাঁচামাল ও মুদ্রণ ব্যয় বাবদ ৪৫ কোটি ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৮৬ টাকা খরচ করা হয়েছে। অথচ অর্থ বিভাগের স্মারক অনুযায়ী এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উল্লিখিত শ্রেণীর কাজে সংস্থার নির্বাহী প্রধান সর্বোচ্চ ৮ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে পারেন। কিন্তু ইফায় ডিজির অনুমোদনক্রমে ওই সীমার অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কোনো একক ক্রয় একাধিক প্যাকেজে বা কোনো প্যাকেজ একাধিক লটে বিভক্ত হলেও মোট মূল্যের সমষ্টি এখতিয়ারভুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের জন্য পেশ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ইফার এই ব্যয়ে তাও করা হয়নি। এ ব্যাপারে ইফা প্রেসকে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো নয় দাবি করে ব্যয়ের সঠিকতা দাবি করা হলেও নিরীক্ষায় তা নাকচ করে দিয়ে বলা হয়, ইফা প্রেস জিওবি প্রকল্পের মাধ্যমে স্থাপিত এবং স্থাপনাটিও সরকারি। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ রয়েছে নিরীক্ষায়।

৭টি গাড়ি অকোজো ঘোষণার পর মেরামত ও জ্বালানি খরচ দেখানো: ২০১৬ সালে ইফার ৭টি গাড়ি অকেজো ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এরপরও এই গাড়িগুলোর মেরামত ও জ্বালানি খরচ বাবদ ২৮ লাখ ২০ হাজার ৯৭০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ইফার পক্ষ থেকে বলা হয়, গাড়িস্বল্পতার কারণে অকেজো গাড়িগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। নিরীক্ষায় বলা হয়, কনডেমনেশন বা অকেজো ঘোষণার পর সেই গাড়ি মেরামত ও জ্বালানি ব্যয় করার কোনো অবকাশ নেই।

মডেল মসজিদের টাকায় ইফা কার্যালয়ের রুম ডেকোরেশন: ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ প্রকল্পের টাকায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন ভবনের রুম ডেকোরেশন করা হয়েছে। প্রকল্পের দফতর ব্যবহার উপযোগী করার নামে ১২ লাখ ১২ হাজার ১৪৫ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। রুমকে থাই অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা সাজানো, টয়লেট নির্মাণ, রং ইত্যাদি কাজ করা হয়েছে গত ১০ মে ২০১৮ তারিখে। কিন্তু ডিপিপিতে এই ধরনের কাজের কোনো বরাদ্দ নেই। নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রকল্প অফিসটি ইফা ভবনে অবস্থিত। রুম সংস্কার করতে হলে সেটা ইফার বরাদ্দ থেকে হওয়ার কথা। অনিয়মিত ব্যয় আদায় করতে বলা হয়েছে নিরীক্ষার সুপারিশে।

ডিপিপি প্রণয়নের নামে ক্ষমতাবহির্ভূত সম্মানী প্রদান: অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো কর্মকর্তাকে ১০ হাজার টাকার ওপরে সম্মানী প্রদান করতে হলে অর্থ বিভাগের সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। ইফার ৫৬০টি মডেল মসজিদ নির্মাণ, ইসলামিক মিশন হাসপাতাল কমপ্লেক্স প্রকল্পসহ কয়েকটি প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি বাবদ সম্মানী ভাতা হিসেবে ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিজিসহ কয়েকজন কর্মকর্তাকে সম্মানী ৫০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। অথচ ডিপিপি তৈরিতে এসব কর্মকর্তা জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। আপত্তিকৃত অর্থ আদায়ের পক্ষে মত দেয়া হয়েছে নিরীক্ষায়।

আদেশ লঙ্ঘন করে সমাপ্ত প্রকল্পের যানবাহন ব্যবহার ও জ্বালানি ব্যয়: অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সমাপ্ত প্রকল্পের যানবাহনের জ্বালানি ব্যয় রাজস্ব খাত থেকে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু গত দশ বছরে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে তা মানা হয়নি।

সমাপ্ত প্রকল্পের যানবাহনের জ্বালানি ব্যয় বাবদ রাজস্ব খাত থেকে ৬২ লাখ ৫১ হাজার ৫৩১ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। উপরন্তু প্রকল্প শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে প্রকল্পের গাড়ি জমা দেয়ার নির্দেশ না মেনে বছরের পর বছর ইফার আগারগাঁও দফতর সেগুলো ব্যবহার করছে এবং রাজস্ব বাজেট থেকে খরচ নির্বাহ করছে। ৮/০২/২০১৬ তারিখেও একটি পাজেরো জিপ মেরামত বাবদ ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা ব্যয় পরিশোধ করা হয়েছে। ইফার জবাবে বলা হয়, ইফার ১০টি গাড়ি দিয়ে কাজ পরিচালনা কষ্টসাধ্য। তাই প্রকল্পের গাড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে। নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকারি নির্দেশ লঙ্ঘন করে তা করার কোনো সুযোগ নেই।

এ ছাড়াও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অভিজ্ঞতা ছাড়া পদোন্নতি প্রদান, পুস্তক প্রকাশনা ওয়ার্কশপের নামে ৬৪ লাখ টাকা ব্যয় প্রকল্পের বাইরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৪ লাখ টাকা ভ্রমণভাতা প্রদান এবং ডিপিপি লঙ্ঘন করে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকায় বোগদাদি কায়দায় মুদ্রণের মতো অনিয়ম ধরা পড়েছে নিরীক্ষায়।