ঢাকা-দিল্লি সোনালি অধ্যায় শেষের শঙ্কা

ঢাকা-দিল্লি সোনালি অধ্যায় শেষের শঙ্কা

কয়েক মাস ধরেই ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধন বিল ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে যে বিতর্ক চলছিল, পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনীতিকেরা। পরিস্থিতি নিয়ে তাদের উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছিল। চলতি সপ্তাহে ভারতের পার্লামেন্টে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিতাড়ন ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংখ্যালঘুদের অত্যাচার বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য নিয়ে দেশের জনগণের মন্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনীতিকদের না শোনার কথা নয়।

চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) থেকে বাদ পড়েছেন আসামের ১৯ লাখ মানুষ।কৌশলগতভাবে ভারতের ও ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জন্য গুরুত্বপূর্ণ উত্তর –পূর্বাঞ্চলের রাজ্যটিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রায়ই এনআরসি থেকে বাদ পড়া ব্যক্তিদের বের করে দেওয়ার কথা বলছেন। জনসমক্ষে তাদের বক্তৃতায় সাধারণত স্পষ্ট করে কোনো দেশের নাগরিকদের বের করে দেওয়া হবে বলা না হলেও ধারণা করা হয় বের করে দেওয়া লোকজনে গন্তব্য হবে বাংলাদেশ।

গত অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকে এনআরসির বিষয়টি উঠে আসে। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হক বলেন, নয়াদিল্লির প্রতিশ্রুতিতে ঢাকা আশ্বস্ত হয়েছে। দিল্লি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে এনআরসি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তবে এ নিয়ে কী ঘটছে, তার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকবে।

ভারতের গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশ–ভারতের সম্পর্ককে ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসেবে নেতারা বর্ণনা করলেও ভারতীয় পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে তীব্র বিতর্কের পর ঢাকার পক্ষ থেকে অস্বস্তি আরো বাড়বে-এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। রাজ্য সভায় ওই বিল পাস করার আগেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ভারতের লোকসভায় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অমিত শাহের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না। বরং তারা শান্তি এবং সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত যা বলছে তা সত্য নয়। বিশ্বের খুব কম দেশই আছে, যেখানে বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। আমাদের কোনো সংখ্যালঘু নেই। আমরা সবাই সমান। তিনি যদি বাংলাদেশে কিছুদিন থাকেন, তিনি এখানকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণ দেখতে পাবেন।’

মোমেন বলেন, ‘ভারতের নিজেরই অনেক সমস্যা বিদ্যমান। বন্ধুদেশ হিসেবে আমরা আশা করি, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট হয়।.

বিল পার্লামেন্টে আসার আগে ভারতে বাংলাদেশের বিদায়ী হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী বলেন, ‘ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে আমাদের নিয়ে সমালোচনা হয়। কিন্তু আমি বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ সমুদ্র সাঁতরে ইতালিতে যাবে, তবু ভারতে আসবে না। যেসব দেশে বাংলাদেশের মানুষ ভালো আয় করতে পারবে, সেখানে যাবে কিন্তু ভারতের মতো কম আয়ের দেশে আসবে না।’

বিদায়ী হাইকমিশনার ভারতের তাঁর বিদায় অনুষ্ঠানে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, এ অঞ্চলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অন্যদের তুলনায় ভালো। এ বছর ৮ থেকে ৮.১ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বাংলাদেশ। ২০২০ সাল নাগাদ ভারতকেও ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ভারতের এসব অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে ভারতের নেতাদের কথাবার্তা ও তাড়ানোর ভয় বিশেষ করে নির্বাচনী প্রচারের সময় তাদের আচরণ মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে বলেই তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তাদের কী জবাব দেবেন?

নাম প্রকাশ না করে আরেক কূটনীতিক বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার ভারতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাংলাদেশ। ভারতের মতো একজন বন্ধু এনআরসি নিয়ে এভাবে কেন আচরণ করছে, তা বোধগম্য নয়।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ভারতের সঙ্গে উন্নয়ন ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোয় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি না হলেও সমুদ্রসীমা ও সীমান্ত সমস্যা সফলভাবে সমাধান হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, নাগরিকত্ব সংশোধন বিল এবং এনআরসি থেকে তৈরি বিতর্কিত নানা উপাদান বা এগুলো ঘিরে তৈরি হওয়া উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় অনেক ভালো কাজকে ভেস্তে দিতে পারে। প্রথম আলোর সৌজন্যে।