রোতান আতঙ্কে অবৈধরা ছাড়ছেন মালয়েশিয়া

রোতান আতঙ্কে অবৈধরা ছাড়ছেন মালয়েশিয়া

মালয়েশিয়া সরকারের সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র ১২ দিন বাকি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যেসব অবৈধ বিদেশী কর্মী মালয়েশিয়া ছাড়তে ব্যর্থ হবেন, তাদের জন্য ‘রোতান’ (বেত্রাঘাত) ছাড়াও অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। এরই মধ্যে সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশী নাগরিক দেশে ফিরে গেছেন। আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কত অবৈধ শ্রমিক দেশে ফিরতে পারবেন, সেটি নির্ভর করছে ইমিগ্রেশন থেকে ট্রাভেল ডকুমেন্ট সংগ্রহ ও বিমান টিকিট পাওয়ার ওপর। তবে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত যাওয়ার সংখ্যা এবার ৫০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

যদিও এ মুহূর্তে বাংলাদেশ বিমানসহ প্রতিটি এয়ারলাইন্সের টিকিটের দাম নির্ধারিত দামের চেয়ে আড়াই থেকে প্রায় তিন গুণ বেশি। হঠাৎ করে বিমান টিকিটের আকাশছোঁয়া দাম বাড়ার পাশাপাশি কুয়ালালামপুর শাহআলম ইমিগ্রেশনসহ বিভিন্ন ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে দালালদের হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হয়ে অনেকের দেশে ফেরা নাও হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা আশঙ্কা করছেন।

কুয়ালালামপুর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের পরিচ্ছন্ন নগরী শাহআলম এলাকার ইমিগ্রেশন অফিসসংলগ্ন এলাকায় গত মঙ্গলবার সরেজমিন দেখা যায়, রাস্তার সামনে বাংলাদেশী, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের অবৈধ শ্রমিকরা ট্রাভেল পাস সংগ্রহে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। গতকাল বুধবার সকাল ৮টায় অফিসের কার্যক্রম খোলার অপেক্ষায় প্রত্যেক কর্মী পাসপোর্ট, বিমান টিকিটের ফটোকপি এবং ৭০০ রিংগিত জরিমানা দিয়ে আউট পাস সংগ্রহ করতে এক দিন আগে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তবে লাইনে দাঁড়ানো বাংলাদেশী কর্মীদের অভিযোগ স্থানীয় দালালরা লাইন ধরেনি, অনেককে আগে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। এতে তারা রাতভর ভোগান্তির পরও কাক্সিত ট্রাভেল পাস পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ করছেন। আবার কেউ পেলেও দেরিতে পাচ্ছেন।

লাইনে দাঁড়ানো পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার বাসিন্দা ফয়সাল হোসেন প্রতিবেদককে বলেন, মালয়েশিয়াতে ৫-৬ বছর ধরে আছি। মালয়েশিয়া সরকার দেশে ফিরতে এবার চার মাসের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দিয়েছেন। আমি এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য ট্রাভেল ডকুমেন্ট পেতে রাতেই লাইনে এসে দাঁড়িয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে ফয়সাল বলেন, রাত যত বাড়বে মানুষের ভিড় ততই বাড়তে থাকবে। এর মধ্যে বৃষ্টি পড়লে দৌড়ে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেবো আবার লাইন ধরব। এভাবে রাতটা এখানে দাঁড়িয়েই কাটাব। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, দুই দিন আগে আমার সাথে ছিলেন এমন দু’জন এখানে রাত কাটিয়ে পরদিন ট্রাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে বাড়ি গেছেন। তারা দেশে ফিরে আমাকে বলেছেন, বিমানের টিকিট বাতিল হয়েছে এমন লোককে দালালরা লাইনের মাঝখান থেকে বের করে অফিসে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তা হলে আমাদের রাত জেগে কী লাভ হলো? তার পরও মালয়েশিয়া সরকার একটু সুযোগ করে দিয়েছেন এর জন্য তাদেরকে ধন্যবাদ। কারণ অবৈধ জীবন আর ভালো লাগে না। তার মতে, সব অবৈধ বাংলাদেশী সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নেয়া উচিত।

যশোর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দা একই লাইনে দাঁড়ানো অপর দুই শ্রমিক নয়া দিগন্তের সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে বলেন, এখন কষ্ট করে ট্রাভেল ডকুমেন্ট পেলে ২১ তারিখ এয়ার এশিয়ার ফাইটে দেশে যেতে পারব। টিকিট কাটা হয়েছে। তবে অনেক দাম। কুয়ালালামপুর থেকে শুধু ঢাকা যেতে বিমানের টিকিটের দাম লাগছে ২০০০ রিংগিত। তাও মিলছে না। অন্য সময় মাত্র ৫০০-৬০০ রিংগিত এ টিকিট পাওয়া যায়। টিকিটের দাম বেশির কারণে অনেকে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না জানিয়ে বলেন, এবার সবার মুখে শুনছি, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যারা যাবেন না, তাদের বেত্রাঘাত দেয়া হবে। এই দেশের ভাষায় এটিকে ‘রোতান’ বলে। সাথে আরও জেল-জরিমানা তো হবেই। এটা শুনে অনেকে ভয়ে চলে যাচ্ছে। তারা বলেন, চার মাসের সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩১ ডিসেম্বর।

আমাদের সরকার থেকে যদি আরও দু-এক মাস সময় বাড়ানোর সুযোগ করে দিত, তা হলে অবৈধ আরও অনেক লোক দেশে ফিরতে পারত। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, কলিংয়ে এসে তারা অবৈধ হয়েছেন। তিন বছরে পুঁজি তোলার পর কিছু টাকা লাভ হয়েছে। কী আর করার। এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ। দেশে ফিরে যাওয়াই ভালো। উল্লেখ্য গত ১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার মাসের জন্য মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ অবৈধ বিদেশীদের দেশ ত্যাগ করতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। নিয়ম অনুযায়ী কর্মীরা পাসপোর্ট/ভিসা এবং টিকিটের ফটোকপির সাথে ৭০০ মালয়েশিয়ান রিংগিত জমা দিলে ইমিগ্রেশন অফিস থেকে ট্রাভেল পাস ইস্যু হবে। এরপর নির্ধারিত ফাইটে কর্মীরা ফিরে যাবেন। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪০ হাজারের মতো বাংলাদেশী ফিরে গেছেন। এ সময়ের মধ্যে অন্যান্য দেশের লক্ষাধিক নারী-পুরুষ কর্মীও ফিরেছেন।

অবৈধ শ্রমিকদের দেশে ফেরত যেতে সাধারণ ক্ষমার মেয়াদ আর নাও বাড়তে পারে এমন আশঙ্কায় কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের চিঠি পেয়ে বাংলাদেশ সরকার ভর্তুকি দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিশেষ ফাইটে কর্মীদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ইতোমধ্যে যেসব শ্রমিক বিশেষ ফাইটে দেশে ফিরেছেন, তারাই শুধু প্রতি টিকিটে ১২ হাজার টাকা করে ভর্তুকি পাবেন।

এ দিকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর, কাং, শাহ আলম ও বিমানবন্দর সড়ক এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই অধৈভাবে যারা অবস্থান করছেন এমন সন্দেহজনক নাগরিকদের চেকপোস্ট বসিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। যাদের কাগজ নেই তাদেরকে অপারেটিং দলের সদস্যরা ধরে ইমিগ্রেশনে নিয়ে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোমের বাসিন্দা কন্সট্রাকশন ব্যবসায়ী হাজী আবদুর রহিম বলেন, মূলত যেসব অবৈধ নাগরিক এখনো দেশ ছাড়ার চিন্তা করছে না, তাদের জন্যই অভিযান চলছে। ৩১ ডিসেম্বরের পর আগামী দুই মাস সারা মালয়েশিয়াজুড়ে ব্যাপক ধরপাকড় অভিযান শুরু হবে। তবে তার মতে মালয়েশিয়ায় কমপক্ষে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ অবৈধ শ্রমিক রয়েছেন। সে তুলনায় এবারের দেশে ফেরার সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার হবে। এর মধ্যে রিহায়ারিংয়ের মাধ্যমে বৈধতা পেতে যে ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ বিদেশী শ্রমিক তিনটি এজেন্টের মাধ্যমে রিংগিত জমা দিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই বৈধতার কাগজপত্র পাননি।

সিলানগর এলাকার একটি কন্সট্রাকশন কোম্পানির সাব কন্ট্রাকটর যশোরের বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম  আক্ষেপ করে বলেন, দীর্ঘ ৫ বছর ধরে এ দেশে আছি। কিন্তু ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে দেশে যেতে পারছি না। কারণ ২০১৪ সালে রিহায়ারিংয়ের মাধমে বৈধ হতে লেভি, মেডিক্যাল, ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেয়ার পরও আজো আমি বা আমার মতো অনেকেই বৈধ হতে পারেনি। অথচ আমার এজেন্ট রেজোয়ান সাড়ে ৮ হাজার রিংগিত নিয়ে এখনো বলছেন, তোমাদের একটা ব্যবস্থা হবে। এখন কবে হবে সেই অপেক্ষায় সময় কাটাচ্ছি। প্রতি মুহূর্ত আতঙ্কে আছি। পুলিশ না ধরে ফেলে। তার পরও মনোবল চাঙ্গা রেখে চলছি। যা হয় হবে। দেশে যামু না। কারণ দেশে গিয়ে থাকতে হবে বেকার। তাই এখানে পালিয়ে থেকে দেখি শেষ পর্যন্ত কী হয়? সূত্র: নয়া দিগন্ত

এমজে/