আবারো জেঁকে বসেছে শীত

হাসপাতালে ছুটছেন হাজার-হাজার মানুষ, ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ্বর

হাসপাতালে ছুটছেন হাজার-হাজার মানুষ, ঘরে ঘরে সর্দি কাশি জ্বর

দুই সপ্তাহ আগে দেশে হঠাৎ জেঁকে বসেছিলো শীত। এরপর আসলো কিছুটা গরম। এখন আবারো সারা দেশে শীত জেঁকে বসেছে। শীতের দাপটের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে কনকনে ঠান্ডা আবহাওয়া। শীত আর ঠন্ডায় সর্দিজ্বর, কাশি আর বুকে শ্লেষ্মা বা কফ জমে অসুস্থ হয়ে পড়ছে মানুষ। বিশেষ করে প্রায় প্রতিটি ঘরে শিশুরা সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছে।

শীতকালীন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটছেন হাজার-হাজার মানুষ। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারসহ স্থানীয় ফার্মেসিগুলোয় এখন রোগীদের ছোটাছুটি। আবার অনেকে বাসায় বসেই ওষুধ সেবন করছেন। এই সর্দি, জ্বর, হাঁচি-কাশির সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়েছে চীনের করোনা ভাইরাস। যদিও বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।

রাজধানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটডোরে গতকাল শনিবার সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে যান মগবাজারের বাসিন্দা শরাফতউল্লার। তিনি

গণমাধ্যমকে বলেন, তার ১০ বছর বয়সী মেয়ে ও স্ত্রীসহ পরিবারের তিন সদস্যের সবাই সর্দিজ্বরে ভুগছেন। শুধু শরাফতউল্লা নয়, তার মতো আরও অনেকেই হাজির হয়েছেন ঠা-াজনিত রোগের চিকিৎসা নিতে।

হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এসব রোগের পাশাপাশি শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমার প্রকোপও বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৪ হাজার ৩৪৮ জন রোগী দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আক্রান্তদের হিসাব বলছে, ঠান্ডাজনিত রোগব্যাধিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন খুলনা বিভাগে। এ বিভাগের ১০ জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৩৮৭ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ৭০৮ জন রোগী যশোর জেলার। যশোর জেলায় সবচেয়ে বেশি রোগী সর্দিজ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন।

বিভাগ অনুযায়ী আক্রান্তের সংখ্যা ঢাকায় ৭৩০৪১, ময়মনসিংহে ৩৯২৩০, চট্টগ্রামে ১২০৯৮৩, রাজশাহী ২৮৮৮০, রংপুর ৩০৯৩১, খুলনায় ৯৩৭০৬, বরিশালে ১৯৮৮০ এবং সিলেটে ২৬৩৮৮ জন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, শীত এলে মানুষ সর্দি, জ্বর, কাশি, গলাব্যথা, টনসিলের ও বাত-ব্যাথা, ব্রংকাইটিস, সিওপিডি, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করাই এ সময় বেশি আক্রান্ত হন। শীতকালে শ্বাসতন্ত্রের রোগে উল্লেখযোগ্য মানুষ আক্রান্ত হন এবং শ্বাসতন্ত্রে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও বেশি।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির গণমাধ্যমকে বলেন, শীতকাল এলে ধুলাবালি বেশি ওড়ার কারণে গলাব্যথা, টনসিল, কান ব্যথা, এলার্জি ও শ্বাসতন্ত্রের রোগ বাড়ে। এবারও ব্যতিক্রম নয়। সারা দেশেই শীতকালীন রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

অধ্যাপক ডা. ইউসুফ ফকির বলেন, শীতকালীন রোগগুলো থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বেশ সতর্ক থাকতে হয়। ঠান্ডার সময় দুই রকম কথা মনে রাখতে হবে। কখনো কখনো দিনের বেলা গরম থাকে। তখন এক রকম আবার তাপমাত্রা কমে গেলে আরেক রকম অবস্থা হয়। তাপমাত্রা কমে গেলে গরম কাপড় পরতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে শরীর যেন না ঘামে। অনেক মা-বাবা গরমের কথা মনে করে বেশি গরম কাপড় পরায়। এ কারণে ঘাম বেশি হয়ে বাচ্চার সর্দি-কাশি বেড়ে যায়। বাচ্চাদের খালি পায়ে ঠান্ডা ফ্লোরে হাঁটতে দেওয়া যাবে না। বাচ্চাদের গোসল করায় সময় বেশি সময় না নেওয়া এবং কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করাতে হবে। ঠান্ডা বাতাস থাকলে সেদিকে বাচ্চাদের না নিয়ে যাওয়াই ভালো। বেশি লোকসমাগমের স্থানগুলো বাচ্চাদের নিয়ে চলার সময় এড়িয়ে চলতে হবে। শীতের সময় ধুলাবালি বেড়ে যায়, সেই ধুলাবালি থেকে বাচ্চাদের রক্ষা করতে হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউর) বক্ষব্যাধি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শীতকালীন রোগ কিছুটা বেড়েছে। শিশু ও বয়স্কদের ফুসফুসের রেজিস্ট্যান্স কম থাকে। এ কারণে এ দুই শ্রেণির মানুষই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। শিশু ও বয়স্কদের আবার নিউমোনিয়ায় মৃত্যুঝুঁকি বেশি। সর্দিজ্বর হাঁচি, কাশি সব বয়সীরা আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ বছরের কম ও স্কুলগামী শিশু বেশি। এ ছাড়া যাদের সিওপিডি, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা রয়েছে তারাও শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। যাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কিডনিতে সমস্যা রয়েছে, তাদের ফুসফুসের কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। তারাও সর্দি, জ্বর ও কাশিসহ ঠা-াজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেডিসিন স্টোরের এসএলপিপি ডা. মশিউর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, অন্য সময়ের তুলনায় বর্তমানে ঠা-াজনিত রোগব্যাধির ওষুধের চাহিদা বেড়েছে।

জানা গেছে, শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন তাদের তথ্য সংগ্রহ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ২৯৬টি উপজেলার ৪ হাজার ৩৪৮ মানুষ সর্দিজ্বরসহ শীতকালীন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। গত ১ নভেম্বর থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর বাইরেও বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, শীতকাল এলে কিছু রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। বিশেষ করে সর্দি, জ্বর, কাশি, শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়রিয়ার হার বেড়ে যায়। এ ছাড়া আমাশয়, জন্ডিস ও চোখের প্রদাহ বাড়ে। যারা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়ে থাকেন তাদের তথ্য কন্ট্রোল রুম থেকে সংগ্রহ করা হয়।

কন্ট্রোল রুমের তথ্যানুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ২৯৬টি উপজেলার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে একিউট রেসপিরেটরি ট্র্যাক ইনফেকশন (এআরআই) রোগী ৭৮৬ জন, ডায়রিয়া ১ হাজার ৬৪০ এবং অন্য (জ্বর, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ ও জন্ডিস) রোগী ১ হাজার ৯৬০ জনসহ মোট ৪ হাজার ৩৪৮ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন।

চলতি বছরে ১ নভেম্বর থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত এআরআই রোগী ৬৮ হাজার ৭০২ জন, ডায়রিয়া ১ লাখ ৬৬ হাজার ২৭ এবং অন্যান্য রোগী ১ লাখ ৯৮ হাজার ৩১০ জনসহ মোট ৪ লাখ ৩৩ হাজার ৩৯ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। একই সময়ে এআরআই রোগে ২২, ডায়রিয়ায় ৫ ও অন্য রোগে ৩০ জনসহ মোট ৫৭ জন মারা গেছেন।