টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার

টাকার খোঁজে দিশেহারা সরকার

অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশি টাকা প্রতিবেশী দেশের মুদ্রার তুলনায় অতিমূল্যায়িত। চীন, ভারত, পাকিস্তান তাদের মুদ্রামান কমিয়েছে। এ অবস্থায় সরকার টাকার মান না কমিয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রণোদনা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ, টাকার মান কমিয়ে দিলে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এই নীতি কত দিন কার্যকর থাকবে। দীর্ঘ মেয়াদে এই টাকা কোথা থেকে আসবে? রপ্তানি–প্রণোদনাও তো রপ্তানি–ধস ঠেকাতে পারছে না। প্রণোদনার কারণে রেমিট্যান্স ও তথ্যপ্রযুক্তি আয় বেড়েছে, তবে বৈদেশিক মুদ্রা এই মুহূর্তে সংকটে নেই বলে নগদ প্রণোদনা খুব বেশি জরুরি নয়। টাকার মান সামান্য কিছু অবমূল্যায়ন করেও একই টার্গেট অর্জন সম্ভব।

সঞ্চয়পত্র সুদ বনাম এক অঙ্কের সুদ: ডাকঘরে আমানতের সুদের হার এক ধাক্কায় সরকার অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে। আগে যা ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। এখন তা ৬ শতাংশ। এর আগে সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করে সরকার। ব্যাংকের সুদ ৬ শতাংশ, মূল্যস্ফীতি ৬ বা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকে রাখাও যা, না রাখাও তা, সঞ্চয়পত্রে সুদও তা। সরকার কেন এটা করল? অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের কথায়, ‘রাজস্ব কমে যাওয়ায় সরকার প্রথমে হাত দিল ব্যাংকে। ছয় মাসের মধ্যে এক বছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ করল। তারপর নতুন আইন করে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোর অর্থে হাত দিল। এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের শেয়ার পুঁজিবাজারে দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকের হারানো তহবিলের ঘাটতি কমাতে। অথচ ব্যাংকের টাকা যারা নিয়ে গেল, তাদের ধরছে না। এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোয় জনগণের দুর্বল অংশ যে পেনশনভোগী, তাঁদের আয়ে হাত পড়ল। তাঁদের সুদ বাবদ রাষ্ট্রের খরচ কমল। ওদিকে ইউএনওদের ৯৪ লাখ টাকার গাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

সরকারের ঋণ বনাম ব্যক্তি খাতের ঋণ : যেখানে সরকার নিজেই অতি উচ্চ পরিমাণে ব্যাংকঋণ করছে, সেখানে বেসরকারি খাতে এবং ব্যক্তি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়বে কীভাবে? ২০১১-১২ অর্থবছরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসে ২৩ দশমিক ২৬ শতাংশে স্থবির হয়েছে। সরকারের অতি উচ্চ ঋণের প্রভাবে ১১ বছরে বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বনিম্ন ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশে এসে পৌঁছেছে।

স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নেওয়ার বিপদ : স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থের স্থিতি ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। বিরোধী দলের তীব্র বিরোধিতা, এমনকি ওয়াকআউটের মধ্যেই সরকার স্বশাসিত সংস্থাগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে যাওয়ার আইন পাস করেছে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্রমবর্ধনশীল রাজস্বঘাটতির বিপরীতে সরকার তার অতি উচ্চ ব্যয় নির্বাহের নতুন জোগান পেলেও এর মাধ্যমে তৈরি হতে পারে বেশ কয়েকটি গুরুতর সমস্যা। উদ্বৃত্ত অর্থ যাতে একেবারেই না থাকে, সে জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়াতে পারে, এতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী উৎসাহ পাবে। নিজস্ব তহবিলের স্থিতি ও তার বিপরীতে আয় না আসায় সরকারের ওপর অতি নির্ভরশীল হবে সেবা, গবেষণা ও পরিকল্পনা। প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের সিদ্ধান্ত আর্থিক কারণে নিতে পারবে না বিধায় স্বায়ত্তশাসিত কাঠামো বলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না বলে আশঙ্কা হয়। মারাত্মক আর্থিক বিশৃঙ্খলার সম্ভাবনায় এবং তহবিলের নিশ্চয়তা না থাকায় ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলো গতি হারাতে পারে। মোটকথা, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্পৃহা ধ্বংস হয়ে যাবে। তা–ই যদি হয়, দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শাসনের পথে এটা একটা কালো অধ্যায় হয়েই থাকবে।

নিম্নপর্যায়ে আমানত সুরক্ষার ঝুঁকি : আমানত সুরক্ষার খসড়া আইনে বলা হচ্ছে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান অবসায়নে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র এক লাখ টাকা। এতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে লালবাতি জ্বললে মাঝারি ও বড় আমানতকারীদের সুরক্ষাহীন হয়ে ভীত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এক অঙ্কের সুদনীতির সঙ্গে এটা সরাসরি সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে। কেননা, ৬ শতাংশের ওপরে থাকা মূল্যস্ফীতির সমান বা তারও কম সুদের ফলে লোকে যখন ব্যাংকে টাকা রাখতেই উৎসাহ হারাচ্ছে, তখন দরকার ছিল গ্রহণযোগ্য শতাংশ হারে আমানতের বিমা নিশ্চয়তা দেওয়া। ২০০০ সালের আইনেও এক লাখ টাকার সুরক্ষা থাকলেও ২০ বছর পরে এসেও তা মূল্যস্ফীতি যোগ করে পুর্নির্ধারণ করা হয়নি—যেমনটা ভারতে করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। নতুন আইনে টাকার অঙ্ক বদলায়নি, সংযোজন শুধু নন–ব্যাংকিং আর্থিক খাত। আমানত সুরক্ষার অঙ্ক বাড়ালে বিমা খরচ কিছুটা বাড়লেও নতুন আমানত উৎসাহ পেত। কিন্তু তা না করায় লোকে ব্যাংকে টাকা রাখা কমিয়ে দেবে। এতে ঋণপ্রবাহে দীর্ঘতর নেতিবাচক ধারা সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাবশালী, ব্যাংক মালিক, পরিচালক ও ব্যবসায়ী—এই চার পক্ষ বোঝাপড়ায় একের পর এক জালিয়াতির মুখে আর্থিক খাত যখন টালমাটাল, তখন এমন আইন বৈধ এবং অবৈধ উভয় ধরনের পাচার বাড়াতেই উৎসাহ দেবে। আশঙ্কা হয়, উদ্দেশ্যমূলক ব্যাংক লোপাট করে, আইনি কাঠামোয় দায়মুক্তি দেওয়ার ফন্দি এটা নয় তো! এর মাধ্যমে আমরা কি এই সংকেত পাচ্ছি যে, ব্যাংকগুলো আবারও লুটের কবলে পড়তে যাচ্ছে? বড় ধরনের অনাস্থা ও অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে, নতুন আইনের মাধ্যমে ব্যাংকের আমানত কমে ঋণপ্রবাহে আরও বেশি নেতিবাচক ধারা সৃষ্টি করতে পারে।

ভারতের অনুকরণ!: সরকারের দ্রুত সিদ্ধান্তগুলোর প্রতিযুক্তি হিসেবে বলা হচ্ছে, ভারতেও অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত নিজেই অর্থনৈতিক মন্দায় পড়েছে। তথাপি ভারত মূল্যস্ফীতি ও অন্য বিষয়াদি আমলে নিয়ে আমানত সুরক্ষা স্থিতি এক লাখ রুপি থেকে পাঁচ লাখ করেছে। উপরন্তু, প্রতিটি অর্থনীতি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে আলাদা। ভারতে বাংলাদেশের মতো এত বিশাল খেলাপি ঋণ এবং সরকারি ঋণের সংস্কৃতি নেই। তাই ভারতের পলিসি বাংলাদেশে নকল করা বেমানান। ভারতের সাবেক অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম পরিষ্কার করে দুটো বিষয় উপস্থাপনা করেছেন, যার ভাবানুবাদ এমন: ‘ভারতীয় অর্থনীতির সমস্যা সাপ্লাই সাইডে নয়, বরং ডিমান্ড সাইডে। অর্থাৎ ভারতীয় নাগরিক ক্রয়ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার, এমনকি করপোরেট করে ছাড় বা বড় ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিলে এ সময় কাজ হবে না। বরং এই সময়ে পণ্য কীভাবে বেশি বিক্রি হবে, তার উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নোবেল বিজয়ী অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন কৃষকের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দিতে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে বর্তমান বিজেপি সরকার সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভারতীয় মেধাবীদের সমন্বয় করে অর্থনীতি পরিচালনা করছে না বলে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে ভুল হচ্ছে।’

বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন কোম্পানি ও করপোরেট পণ্য বিক্রিতে ভাটা এসেছে। গত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়লেও কর্মসংস্থানে দেখা দিয়েছে নেতিবাচকতা। ২০১০ সালের পর কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩২ শতাংশ থেকে কমে নেমেছে ১ দশমিক ৩৩ শতাংশে। কৃষক ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অর্থবছরের শুরুতে। পণ্যবাজারে বিক্রয় হ্রাস, কর্মসংস্থানে ভাটা, ব্যক্তি ও বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্যহীনতায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমতাবস্থায় টাকার খোঁজে দিশেহারা হয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভুল করার সমূহ সম্ভাবনা আছে। অর্থ ব্যবস্থাপনায় দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের সমন্বিত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে। সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সৎ, সতর্ক, প্রজ্ঞাবান না হলে চোখের পলকেই বদলে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চালচিত্র!

ফাইজ তাইয়েব আহমেদ: নেদারল্যান্ডসের ভোডাফোনে কর্মরত প্রকৌশলী এবং টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক।