ইন্টারনেট বন্ধে করোনার ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা: এইচআরডব্লিউ

ইন্টারনেট বন্ধে করোনার ঝুঁকিতে রোহিঙ্গারা: এইচআরডব্লিউ

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় ইন্টারনেট সেবা বন্ধ ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে বাংলাদেশ সরকারের বিধিনিষেধের কারণে সেখানে করোনা ভাইরাসের (কভিড-১৯) হুমকি নিয়ে কাজ করতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। শিবিরগুলোয় ত্রাণ সংস্থাগুলোর জরুরি সেবাদান ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়েছে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)।

এইচআরডব্লিউ’র এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছে বাংলাদেশ সরকারের। এর মধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোও রয়েছে। সরকারের কাছে এখন ক্ষতিকর নীতিমালা দিয়ে নষ্ট করার মতো সময় নেই। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিৎ ইন্টারনেট শাটডাউন প্রত্যাহার করে নেয়া। এতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ ও প্রতিরোধ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছানো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।শাটডাউন প্রত্যাহার না করলে, শরণার্থীদের, তাদের আশ্রয়দানকারী কমিউনিটির ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় গত সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট সেবা। কর্তৃপক্ষ এ সেবা বন্ধের সিদ্ধান্তকে নিরাপত্তাজনিত পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছে। তবে এত বিস্তৃত পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ সমানুপাতিক বা প্রয়োজনীয় ছিল না। যদিও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুসারে, এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে এই দুটি শর্তই আবশ্যক।

এইচআরডব্লিউ জানায়, শিবিরগুলোয় ত্রাণকর্মী ও স্থানীয় নেতারা হোয়াটসঅ্যাপ ও অন্যান্য ইন্টারনেট ভিত্তিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জরুরি সেবা সমন্বয় করে থাকে। পাশাপাশি শিবরজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করে। কিন্তু বর্তমানে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় করোনা ভাইরাস সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে ‘কনটাক্ট ট্রেসিং’ (আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা)- এর সক্ষমতা কমছে। একজন কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী জানান, তাদের দল হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে মেডিক্যাল সহায়তাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো। কিন্তু এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না।

চলতি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় এক বিবৃতিতে বলেছে যে, বিশেষ করে, এমন জরুরি সময়ে, যখন তথ্যের প্রবেশাধিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তখন জনশৃঙ্খলা ও জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে ইন্টারনেটের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা যায় না। বিবৃতিতে, জাতিসংঘ বিভিন্ন দেশের সরকারের প্রতি ইন্টারনেট সেবা বন্ধ না করতে আহ্বান জানিয়েছে। একইসঙ্গে যেসব জায়গায় এমন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, সেখান থেকে তা প্রত্যাহার করে সবচেয়ে দ্রুত ও সুলভ ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করতে বলেছে।

বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের দাবি, এখন পর্যন্ত শরণার্থী শিবির বা এর আশপাশের এলাকাগুলোয় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেনি। কিন্তু মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য পর্যাপ্ত পরীক্ষা করা হয়নি। বাংলাদেশে ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে নেতৃত্বদানকারী সংস্থা জাতীয় রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এখন পর্যন্ত মাত্র ১০২৫ জনের পরীক্ষা করেছে। যেখানে পুরো বাংলাদেশের জনসংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৭ কোটি। ঢাকার বাইরে বর্তমানে পরীক্ষা করার ব্যবস্থা সীমিত। অক্সিজেন, রেসপাইরেটর ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সরঞ্জামেরও তীব্র ঘাটতি রয়েছে। আসন্ন দিনগুলোয় এই ভাইরাস মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তুতি অপর্যাপ্ততো বটেই, এর মধ্যে ঝুঁকিতে রয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরাও। তাদের শিবিরগুলো জনবহুল, ভ’মিধস ও বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে। সেখানে জারি রয়েছে চলাফেরার উপর বিধিনিষেধ। নেই পরিষ্কার পানি, স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ।

ত্রাণকর্মীরা জানান, সরকারি কর্মকর্তারা তাদের করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্ক ছড়াতে পারে এমন আশঙ্কায় রোহিঙ্গা শিবিরগুলোর ভাইরাসটি সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রচারণা চালানো থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছে। রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, শিবিরগুলোর দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশি কর্মকর্তারা শিবিরে ভাইরাসটি নিয়ে প্রচারণা চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এইচআরডব্লিউ জানায়, তথ্যের অভাব উদ্বেগ দূর করার বদলে, ভাইরাসটির নিয়ে ভুয়া তথ্যের ছড়াতে সাহায্য করছে। ৫২ বছর বয়সী এক রোহিঙ্গা নারী বলেন, কেউ তার কমিউনিটিতে ভাইরাসটি নিয়ে তথ্য জানাতে যায়নি। তিনি কেবল ধর্মীয় নেতাদের কাছ থেকে প্রার্থনা করার কথা শুনেছেন। তিনি বলেন, আমরা ১০ বা ১২ জনের দল হয়ে প্রার্থনা করছি। আমরা কেবল এটুকুই জানি। কেউ আমাদের এর বেশিকিছু জানায়নি।

স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা এইচআরডব্লিউকে জানান, কক্সবাজারে কোনো ভেন্টিলেটর নেই। শিবিরগুলোয় নিবিড় পরিচর্যার কোনো সক্ষমতা নেই। যদিও সরকার জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হবে। তবে সে সেবা কিভাবে, কীসের ভিত্তিতে দেয়া হবে তা নিয়ে কোনো স্পষ্ট তথ্য জানায়নি সরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে সরকার, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে এমন ব্যক্তিদের সেল্ফ-আইসোলেট হয়ে যেতে ও আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করতে বলেছে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় মোবাইল সিমকার্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা, ইন্টারনেট শাটডাউন ও মোবাইল নেটওয়ার্কের সীমাবদ্ধতার কারণে শরণার্থীদের পক্ষে ওই হটলাইনে যোগাযোগ করা প্রায় অসম্ভব। প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের আইন অনুসারে, রোহিঙ্গাদের সিমকার্ড কেনার অনুমোদন নেই। এর মাঝে গত সেপ্টেম্বর থেকে শরণার্থীদের কাছে পণ্য বিক্রি করতে মোবাইল অপারেটরগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক কমিশন। তখন থেকে এখন অবধি, শিবির থেকে ১২ হাজারের বেশি মোবাইল জব্দ করেছে কর্তৃপক্ষ। ইন্টারনেট শাটডাউনের ফলে অনেকের কাছে সিমকার্ড থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না।

জাতীয় হটলাইনে প্রবেশাধিকার না থাকায়, রোহিঙ্গাদের জনবহুল শিবির দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে হবে। এতে কমিউনিটি সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

শিবিরে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ রুখতে সরকার রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাদের মৌলিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে তথ্য প্রচার করতে নির্দেশ দিয়েছে। এদের অনেকেই শিবিরের নেতা। তাদের ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আরো বেশি। এসব নেতারা জানিয়েছেন , ইন্টারনেটের ওপর নিষেধাজ্ঞা তাদের কাজের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় ইন্টারনেট শাটডাউন ইতোপূর্বেই সাস্থ্যকর্মীদের জরুরি সেবাদান বিঘ্নিত করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২ ও ১৩ নাম্বার শিবিরে হামে আক্রান্ত হয়ে ডজন খানেক শিশু মারা গেছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছে ওই শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার খবর দেরিতে পৌঁছায়। এতে তারা যথাসময়ে ওই শিশুদের আলাদা করে ফেলতে ব্যর্থ হন। একজন স্বাস্থ্যকর্মী জানান, রোগটি খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের উপর বিধিনিষেধের কারণে তাদের পিতা-মাতারা আমাদের যথাসময়ে সংক্রমণের ব্যাপারে জানাতে পারেননি। আমরা যতক্ষণে জানলাম, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।

এইচআরডব্লিউ’র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এডামস বলেন, করোনা ভাইরাস মহামারীর জন্য রোহিঙ্গা শিবিরগুলো হচ্ছে শুকনা খড়কুটোর বাক্স। কর্তৃপক্ষের তাৎক্ষণিকভাবে শিবিরগুলো থেকে ইন্টারনেট শাটডাউন প্রত্যাহার করা উচিৎ এবং ভাইরাস ও এটির প্রতিরোধব্যবস্থা নিয়ে সঠিক তথ্য সকলের জন্য সহজলভ্য করা উচিৎ।

এমজে/