পুরোনো পথেই হাঁটছে ইসি

পুরোনো পথেই হাঁটছে ইসি

ঢাকা, ৪ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ জন্য তারা নতুন একটি আইনের খসড়াও তৈরি করে। কিন্তু আইন করা নিয়ে জটিলতা তৈরি হওয়ায় সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসি পুরোনো পথেই হাঁটছে। অর্থাৎ বিদ্যমান আইনেই এখন তারা সীমানা নির্ধারণ করতে চায়। এতে বর্তমান সীমানায় খুব বেশি পরিবর্তন আসবে না।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিদ্যমান সীমানায় নির্বাচন করার পক্ষে। অন্যদিকে বিএনপি চায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগের সীমানায় ফিরে যেতে।

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে নেওয়া ইসির কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সীমানায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে একটি আদমশুমারি হলেও গত জাতীয় নির্বাচনের আগে সীমানা নির্ধারণে তেমন কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। শুধু জনসংখ্যার বিচারে সীমানা নির্ধারণ করা হলে শহরে আসন বাড়বে, গ্রামে কমবে। এতে বৈষম্য সৃষ্টি হবে। এসব মাথায় রেখে জনসংখ্যা, ভোটারসংখ্যা, এলাকায় মোট আয়তনকে প্রাধান্য দিয়ে বড় বড় শহরের আসনসংখ্যা সীমিত করে দিয়ে আয়তন, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও উপজেলা ঠিক রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি কমিশনের সক্রিয় বিবেচনায় আছে।

এ জন্য গত জুলাইয়ে একটি নতুন আইনের খসড়াও তৈরি করেছে ইসি। গত ২৭ আগস্ট খসড়াটি কমিশনের বৈঠকে তোলা হয়। সেদিন ইসি সচিবালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়ে দুই সপ্তাহের মধ্যে এই খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তা হয়নি।

ইসির সূত্রগুলো বলছে, খসড়া অনুযায়ী নতুন আইন হলে এবং সে অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ করা হলে সংসদীয় আসনে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন আসবে। তাতে ঢাকায় আসন বাড়ার এবং কোনো কোনো জেলায় আসন কমে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এর ফলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই প্রস্তাবিত এই খসড়া অনুযায়ী আইন হলে সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে উপজেলার অখণ্ডতা রক্ষা করা হলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য ২ নভেম্বর একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে মত দিতে বলা হয়েছিল।

এই সময়সীমা পার হয়েছে ২ ডিসেম্বর। গতকাল রবিবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, এখনো এ বিষয়ে মতামত পাওয়া যায়নি। কারণ এরই মধ্যে উপকমিটির প্রধান যুগ্ম সচিব (আইন) বদলি হয়ে গেছেন। তার জায়গায় এখনো কেউ আসেনি।

তবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ-প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইসি শেষ পর্যন্ত বিদ্যমান আইনেই সীমানা নির্ধারণ করার দিকে এগোবেন। কারণ নতুন আইন অনুমোদন করতে যে সময় প্রয়োজন, তারপর সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে না। বিষয়টি নিয়ে তারাও আলোচনা করেছেন। এ অবস্থায় জেলাভিত্তিক আসন অপরিবর্তিত রেখে বর্তমান আইনে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করার কাজ করা হচ্ছে। তা ছাড়া সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে থাকা আওয়ামী লীগ না চাইলে নতুন আইন পাস হবে না। আর আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে ইসিকে জানিয়ে দিয়েছে যে তারা সীমানার পরিবর্তন চায় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, নির্বাচনের বাকি আছে এক বছরের মতো। এর মধ্যে নতুন আইন করে নতুনভাবে সীমানা নির্ধারণ করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। করতে গেলে জটিলতা তৈরি হবে।

তবে ইসির সঙ্গে সংলাপে বিএনপি বলেছিল, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা যে রকম ছিল, সামনের নির্বাচনেও তা সেভাবেই করা হোক। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, তারা ২০০৮ সালের আগের সীমানা চান। নির্বাচন কমিশনকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কারণ ওই সীমানায় অনেক নির্বাচন হয়েছে। সে সীমানা নিয়ে কারও আপত্তিও ছিল না। এ অবস্থায় বিদ্যমান নাকি নতুন আইন করে তার আলোকে সীমানা পুনর্নির্ধারণ হবে-সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় ইসির সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ-সংক্রান্ত কমিটির প্রধান ও নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের কাছে। তিনি বলেন, তারা দুটি বিষয় মাথায় রেখেই তথ্য সংগ্রহ করছেন। বিষয়টি তারা যথাসময়ে কমিশনে তুলবেন। কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

ইসির একাধিক কর্মকর্তার মতে, দশম সংসদ নির্বাচনের পর কোনো আদমশুমারি না হওয়ায় এবার সীমানা পুনর্নির্ধারণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা নেই। তবে কিছু ছিটমহল যুক্ত হওয়া, নতুন কিছু প্রশাসনিক ইউনিট সৃষ্টি, নদী ও সমুদ্র ভাঙনের কারণে কোনো কোনো প্রশাসনিক ইউনিটের সম্পূর্ণ বা আংশিক বিলুপ্তি, যোগাযোগব্যবস্থার পরিবর্তন এবং প্রশাসনিক ইউনিটের যথাসম্ভব অখণ্ডতা বজায় রাখার স্বার্থে আগামী নির্বাচনের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজন রয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারও মনে করেন, নতুন করে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করাটাই যৌক্তিক ও জরুরি। কারণ সব আসনে ভোটার সমতা আনা দরকার। কিন্তু তা না হয়ে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো অসমতা বেড়ে গেছে। এটি নির্বাচনের মৌলিক নীতির লঙ্ঘন। এ ছাড়া সর্বশেষ সীমানা নির্ধারণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।

একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ইসির ঘোষিত কর্মপরিকল্পনায় বলা হয়েছিল, জুলাই-আগস্টের মধ্যে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের জন্য আগের নীতিমালা পর্যালোচনা করে একটি নতুন নীতিমালা করা হবে। সীমানা পুনর্নির্ধারণের লক্ষ্যে আগস্টে জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সিস্টেমস (জিআইএস) সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। অক্টোবরের মধ্যে নীতিমালার আলোকে বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ৩০০ সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে খসড়া তালিকা প্রণয়ন করা হবে। নভেম্বরে খসড়া তালিকা প্রকাশ করে দাবি, আপত্তি, সুপারিশ আহ্বান করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে আপত্তির বিষয়ে অঞ্চলভিত্তিক শুনানি শেষে সেসব নিষ্পত্তি করে ৩০০ আসনের সীমানা চূড়ান্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হবে। কিন্তু এর কোনোটাই হয়নি।

এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তারা এখন স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিদপ্তর, ভূমি মন্ত্রণালয়, পরিসংখ্যান অধিদপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করছেন। তথ্যগুলো সংগ্রহ করে ইসির তথ্যভান্ডারে ঢোকাতে হচ্ছে। বিলুপ্ত ছিটমহল নিয়েও কিছু জটিলতা আছে। কিছু অতিরিক্ত সময় লাগছে, যাতে কোনো সিদ্ধান্ত অপরিপক্ব না হয়।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনের ন্যূনতম ছয় মাস আগে সীমানা নির্ধারণ চূড়ান্ত করে গেজেট করা উচিত। উপজেলার অখণ্ডতা বজায় রেখে সংসদীয় আসন করতে গেলে সমস্যা হবেই। তিনি বলেন, ১৯৮৪ সালের পর ২০০৮ সালে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এরপর আর ব্যাপকভাবে তা হয়নি। এ কারণে সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। তিনি বলেন, তাঁদের কমিশন সীমানা নির্ধারণ নিয়ে একটি খসড়া এবং ২৮টি সুপারিশ রেখে এসেছিল। বর্তমান কমিশন সেসবও বিবেচনা করে দেখতে পারে। সূত্র : প্রথম আলো

(জাস্ট নিউজ/জেআর/১৮৩০ঘ.)