অমানবিক নির্দেশনা, বিজিএমইএর চরম হঠকারিতা

অমানবিক নির্দেশনা, বিজিএমইএর চরম হঠকারিতা

বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা পড়েছেন ঠিক শাঁখের করাতের সামনে। করোনা মহামারীতে যখন পুরো বিশ্বে প্রাণ যায় অবস্থা ঠিক তখনি অমানবিক এক চিত্র দেখা গেলো আমাদের দেশে। একদিকে লকডাউনে গাড়ি, ট্রেন, লঞ্চ বন্ধ অন্যদিকে কারখানা খুলে মালিকরা বাধ্য করেছেন পােশাক শ্রমিকদের ঢাকা শহরে ফিরে আসতে।

শনিবার সারাদিন ঢাকামুখী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যেই আরেকদফা হঠকারিতার আচরণ দেখাল বিজিএমইএ। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক এবার কারখানা বন্ধ করতে আহবান জানালেন কারখানা মালিকদের। প্রশ্ন উঠেছে যদি বন্ধ করার ইচ্ছাই থাকে তাহলে ঢাকায় নিয়ে আসা হলো কেন শ্রমিকদের?

সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা বাগে আনতে এমন অমানবিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৈরী পোশাক শিল্পের কতিপয় মালিক।

পোশাক শ্রমিকদের নিয়ে এই অমানবিকতা বাকরুদ্ধ সাধারণ মানুষ। অনেকেই তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন সামাাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

মৃত্যুর ভয় আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই মহামারীর সময়ে কেন আসছেন ঢাকায় এ প্রশ্নে সবার একি উত্তর চাকুরি বাঁচাতে।

পেটের দায়ে ঢাকামুখী হয়েছেন লাখো মানুষ। তাদের অধিকাংশই পোশাকশ্রমিক। কার্যত লকডাউনে থাকা দেশের নৌ ও স্থলপথে দেখা যায় মানুষের ভিড়।

যে যেভাবে পারছেন ঢাকায় এসেছেন। কেউ হেঁটে, কেউবা ট্রাকে, কেউ পিকআপে। কারো মনে কোনো আনন্দ নেই। হাসি নেই।

দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকায় যোগাযোগের দুই মাধ্যম মুন্সিগঞ্জে মাওয়া ও রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে দেখা যায় উপচেপড়া ভিড়।

সাধারণত ফেরিতে গাড়ি পারপার করলেও এ সময় সাধারণ যাত্রীতে ফেরি পরিপূর্ণ ছিল। যেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণে দূরত্ব বজায় রাখার কথা সেখানে গায়ে গায়ে লেগে ফেরিতে ঘাট পাড়ি দিয়েছেন ঢাকামুখী মানুষ। যে কোনো মূল্যে তাদের ঢাকা যেতে হবে, চাকরি রক্ষা করতে হবে।

নৌপথের মতো সড়ক পথেও ছিল মানুষের ভিড়। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় ঢাকামুখী মানুষ উঠেছে পণ্যবাহী ট্রাকে। ট্রাক ছাড়াও, পিকআপ, সিএনজি, লেগুনায় করেও ঢাকায় রওনা দিয়েছেন তারা। ট্রাক-পিকআপেও গাদাগাদি করে এসেছেন তারা।

যারা কোনো গাড়িই পাননি বা একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত গাড়ি পেয়েছেন তারা অনেকেই হেঁটে পাড়িয়েছেন যার যার কারখানার এলাকায়।

এমন প্রতিকূল পিরিস্থিতিতে ঢাকায় শ্রমিকদের নিয়ে আসা নিয়ে যখন চারদিকে চলছে তুমুলসমালোচনা তখনি আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পোশাক কারখানা বন্ধ রাখতে বলল বিজিএমইএ। আজ রাতে এমন সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

তৈরি পোশাক কারখানাগুলো ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ রাখতে মালিকদের প্রতি এই আহ্বান জানান বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক। রাতে সাংবাদিকদের কাছে পাঠানো এক অডিও বার্তায় গার্মেন্টস মালিকদের প্রতি এই আহ্বান জানান তিনি।

ঝিনাইদহ থেকে আসা পোশাক কারখানার কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সরকার আমাদের এক ধরনের বিপদে ফেলে দিচ্ছে। যেখানে সারা দেশে লকডাউন চলছে, সেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের কাজ করতে বলা হচ্ছে। আগামীকাল (রোববার) থেকে পোশাক কারখানা খোলা। বাধ্য হয়ে আজ খুব সকালে ভ্যান-রিকশা, কখনো অটোরিকশায় করে দুই ঘণ্টার পথ এভাবে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে ঘাটে এসে পৌঁছলাম। এটা কি ঠিক হচ্ছে?’

খুলনা থেকে ভোর ছয়টায় রওনা দিয়েছেন ঢাকার এক পোশাকশ্রমিক মকিম বিল্লাহ। তিনি বলেন, ‘কোথাও গাড়ি নেই। সারা রাস্তা ভেঙে ভেঙে প্রায় দশ গুণ বেশি টাকা খরচ করে দৌলতদিয়ায় পৌঁছালাম। এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসা যায়?’

বাগেরহাট থেকে কর্মস্থল গাজীপুরের পোশাক কারখানায় যাচ্ছেন দুই বোন মোরশিদা আক্তার ও রিক্তা আক্তার। দুই বোন আজ সকাল সাতটায় অন্যদের সঙ্গে মাইক্রোবাস ভাড়া করে রওনা করেন। দৌলতদিয়া ফেরি ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে তাঁদের জনপ্রতি ৮০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। তিনিও বলেন, ‘একদিকে গাড়ি নেই, আরেক দিকে করোনার ঝুঁকি, এভাবে কি আসা যায়?’

এ রকম আরেকজন একটি ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা হাফিজুর রহমান। ঝিনাইদহ থেকে তিনি ঢাকা যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘রোববার থেকে অফিস খোলা। কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতে আজ (শনিবার) ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। উপায় নাই, বাধ্য হয়ে এভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রওনা হয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, দেশে করোনাভাইরাস নিয়ে যেখানে আমরা সবাই শঙ্কিত, সেখানে এভাবে ভিড় ঠেলে যাওয়া আমাদের জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছি।’

দৌলতদিয়ার ৫ নম্বর ঘাটে সকালে ভিড়ে থাকা রো রো (বড়) ফেরি আমানত শাহর স্টাফ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গতকাল শুক্রবার রাতে কিছু যাত্রী পারাপার হয়েছিল। আজ সকাল থেকে মানুষের ভিড় বাড়তে শুরু করেছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে মানুষের ভিড়ও বাড়ছে। একেকটি বড় ফেরিতে ৩ থেকে ৪ হাজার করে মানুষ পার হচ্ছে।’

সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। পরে এ ছুটির মেয়াদ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

এর মাঝে পোশাক শ্রমিকদের ছুটি দেয় পোশাক খাতের দুই সংগছঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ বাড়লেও পোশাক শ্রমিকদের ছুটির মেয়াদ বাড়ায়নি তারা। তাই আগামীকাল রোববার থেকেই তাদের যোগ দিতে হবে নিজ নিজ কাজে।