শ্রমিকরা বাঁচলো কি মরলো তাতে কার কি আসে যায়!

শ্রমিকরা বাঁচলো কি মরলো তাতে কার কি আসে যায়!

গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের তাদের কারখানায় যোগ দেবার জন্যে ডেকে আনায় শিল্পের মালিকদের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার হচ্ছেন। এই মালিকরা যে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করেছেন সেই বিষয়ে পরে বলি। কেন শ্রমিকরা তাদের জীবন বিপন্ন করে ঢাকামুখী হয়েছেন তা আমার-আপনার জানার কথা।

জীবন ও জীবিকার মধ্যে তাদের জীবিকাকেই বেছে নিতে হয়েছে। কারণ জীবিকা ছাড়া তাদের জীবন রক্ষার উপায় নেই। গত ১০ দিনে সরকার বা মালিকরা কি করেছেন যাতে তাদের মনে হবে যে ঘরে বসে থেকে বাঁচা যাবে ? তাদের কাছে চাল-ডাল-সাহায্য পৌঁছানো গেছে? সরকারের মন্ত্রী-নেতারা সরকারী ‘ত্রাণ’ দিচ্ছেন এমন ভাবে যেখানে সাংবাদিকরা অলৌকিকভাবে ক্যামেরা নিয়ে হাজির হচ্ছেন।

এইসব ত্রাণ বাংলাদেশের উন্নয়নের এইসব কারিগরদের কাছে পৌঁছাবার কথা নয়। দেশে সরকারি হিসেবেই আছে ৬ কোটি দরিদ্র। হতদরিদ্র হচ্ছে ১ কোটি ৬৮ লাখ। তাদের কাছেই কী পৌঁছেছে? মনে করে দেখুন এই শ্রমিকদের কেন এই বিপদ মাথায় নিতে হয়।
২০১৭ সালে নারী শ্রমিকদের ওপর গবেষণা করে চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ ( আইসিডিডিআর,বি ) বলছিলো ৮০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন; কারণ তারা যথেষ্ট খেতে পারেন না। মনে আছে কি এই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি বড় হোটেলে ‘পোশাক শিল্পখাতে মৌলিক পুষ্টি ও খাদ্য সরবরাহ বিষয়ক প্রশিক্ষণ’ বিষয়ক কর্মশালা হয়েছিল। সেখানে জানা গিয়েছিলো যে ৪৩ শতাংশ শ্রমিক দীর্ঘ মেয়াদী অপুষ্টির শিকার। কিন্তু তা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন হয়েছিলো কেন জানেন?

সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো –“এতে পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের ২০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। “ তাদের স্বাস্থ্য নয়, জীবন নয়– উৎপাদনশীলতা হচ্ছে উদ্বেগের বিষয়। ফলে আজকে এখন তারা যা করছেন তার বিকল্প ছিল না। ঐ উৎপাদনশীলতার অজুহাতেই এখন মালিকরা তাদের ডেকে নিয়ে এসেছে। মালিকদের এই আচরণ কেবল অমানবিক নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি। তাদের প্রশ্ন করুন। কিন্তু সাথে সাথে এটাও লক্ষ্য করুন সরকারের ভূমিকা কি।

১ এপ্রিলের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে যে, ‘প্রয়োজনে... রপ্তানীমুখি শিল্পকারখানা চালু রাখতে পারবে’। প্রধানমন্ত্রীর দেয়া ৩১টি নির্দেশের ২৯ নং-এ বলা হয়েছে “শিল্প মালিকগণ শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন”। এই নির্দেশনার ফাঁক গলিয়েই গার্মেন্টস কারখানার মালিকরা সুবিধা নিচ্ছেন। কিন্তু সেটাই কি কারণ ? এর পেছনে কি সরকারের ওপরে চাপ প্রয়োগের কৌশল কাজ করছে ? সময় এবং ঘটনা প্রবাহ দেখলেই বুঝতে পারবেন। গার্মেন্টস মালিকরা সরকারের কাছে চেয়েছিল ‘প্রণোদনা’। মানে টাকা দেয়া হবে কিন্তু তাদের ফেরত দিতে হবে না। সরকার বলেছে দেওয়া হবে ঋণ; ঋণের টাকা গার্মেন্টস মালিকদের শোধ দিতে হবে ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জসহ, অনেকে বলছেন তাদের প্রায় ৪ শতাংশ ব্যয় হবে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে নাখোশ গার্মেন্টস মালিকরা। তাই সরকারের কাছ থেকে ‘প্রণোদনা’ নেওয়ার কৌশল হিসেবেই এখন এই শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন করা হয়েছে, দেশের জনস্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে। দেশকে জিম্মি করা থেকে এটি কী অর্থে ভিন্ন? এই বিপদজনক খেলায় গরিব শ্রমিকরা দাবার ঘুঁটি মাত্র; তারা বাঁচলো কি মরলো তাতে কার কি আসে যায় !

লেখক : অধ্যাপক, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি (ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)