গার্মেন্টস মালিকদের লোভের বলি গোটা দেশ

গার্মেন্টস মালিকদের লোভের বলি গোটা দেশ

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া ভয়ানক ছোঁয়াচে করোনাভাইরাসের কারণে কার্যত অঘোষিত লকডাউন চলছে সারাদেশে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে গণপরিবহন চলাচলে। ভয়াবহ এই মহামারির সংক্রমণ থেকে বাঁচতে শহরে ও গ্রামে মাইকিং করে করে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকেই বাইরে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব ও জনগণের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী পর্যন্ত মাঠে নামানো হয়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে প্রাথমিকভাবে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে সেই ছুটি ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। হঠাৎ করেই গার্মেন্টস কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেয় মালিকরা। এ কারণে শুক্রবার ও শনিবার দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লাখ লাখ শ্রমিক দলে দলে ঢাকায় ছুটতে শুরু করে।

কাজে যোগ দিতে ঠাসাঠাসি করে কর্মস্থল ঢাকা অভিমুখে ছুটতে দেখা গেছে পোশাককর্মীদের। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও বৃহত্তর ময়মনসিংহ থেকে পণ্যবাহী খালি ট্রাক, পিকআপ, ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাসহ নানা যানবাহনে ঢাকায় ফিরতে দেখা গেছে তাদের। সাভার, গাজীপুর, মাওয়াসহ ঢাকার প্রবেশদ্বারগুলোতে কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে হাঁটতেও দেখা গেছে হাজার হাজার শ্রমিককে। ফেরি ঘাটগুলোতেও ছিলো উপচেপড়া ভিড়। সামাজিক দূরত্ব তো দূরের কথা একজন আরেকজনের নাকে নাকে বাড়ি খাওয়ার মতো অবস্থা ছিলো।

কিন্তু সারাদেশ যেখানে কার্যত অবরুদ্ধ সেখানে হঠাৎ করে এতটা অমানবিক ও ভয়ংকর পথে লাখ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিককে কেন ঢাকায় ছুটে আসতে হলো- সেই প্রশ্ন এখন সামনে এসেছে। শ্রমিকদের অভিযোগ, গার্মেন্টস মালিকরা এভাবে তাদেরকে ঢাকায় আসতে বাধ্য করেছে। কারখানার পক্ষ থেকে তাদেরকে ফোন করে বলা হয়েছে, ৫ এপ্রিল রোববার কারখানা খোলা হবে। এদিন কাজে যোগ না দিলে তাদের চাকরিচ্যুত করা হবে। এমনকি যে সময়কাল ছুটি দেয়া হয়েছে সেই সময়ের দ্বিগুণ সময়ের বেতন কেটে নেয়ার হুমকিও দেয়া হয়েছে শ্রমিকদের। যে কারণে করোনা মহামারির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, যানবাহন না পেয়েও ঢাকায় ছুটে আসতে হয়েছে তাদের। পোশাককল মালিকদের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতিকদের অনেকেই। গার্মেন্টস কারখানা খোলায় ক্ষুব্ধ শ্রমিকরাও। যদিও তীব্র সমালোচনার মুখে অনেকটা মধ্য রাতে ফের কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গার্মেন্টস মালিকরা।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকামুখী মানুষের স্রোত শুধু সংক্রমণের ঝুঁকিই বাড়াবে না, পুরো দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। হাজার হাজার মানুষের গায়ে গায়ে লেগে ঢাকায় ফেরার এ ধরনের দৃশ্য করোনা প্রতিরোধের বিপরীতমুখী চিত্র। এদের মধ্য থেকে কিছু লোকও যদি আক্রান্ত থাকে, তাদের মধ্য থেকে সামাজিকভাবে অনেকে সংক্রমিত হতে পারেন। লাখ লাখ পোশাককর্মীর মাধ্যমে দেশজুড়েও দ্রুতই ছড়িয়ে পড়তে পারে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস, যা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।

তাহলে এমন ভয়ংকর অবস্থার মধ্যেও হঠাৎ করে কারখানা মালিকরা কেন গার্মেন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নিলো? কার স্বার্থে গোটা দেশকে তারা এই বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে- সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, কোথায় গেলো আমাদের শারীরিক দূরত্ব, কোথায় গেলো মানুষের ঘর বন্দি করার জন্য সকল কর্মযজ্ঞ? কেন কীভাবে এই ভয়ানক পরিস্থিতিতে হাজারো মানুষের ঢল নামানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো? কেন তাহলে এতসব আয়োজন?
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, করোনার এই ভয়ানক পরিবেশে পোশাক শ্রমিকদের এভাবে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়ার অর্থ কী?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গার্মেন্ট মালিকদের মুনাফার অতি লোভের কারণেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বজুড়ে করোনাসংক্রমণ রোধে পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুয়েপমেন্ট-পিপিইর ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। অত্যন্ত চড়া দামে ব্যাপকহারে এই পিপিই রফতানি করতে গার্মেন্ট খোলার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। তবে সবচেয়ে বড় লোভের কারণ হচ্ছে গার্মেন্টস শিল্পের জন্য সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ভাগবাটোয়ারা। প্রণোদনা পেতেই গার্মেন্টস মালিকরা কারখানা খোলার এমন ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে কেবলমাত্র সচল কারখানা মালিকরাই এই প্রণোদনার অর্থ পাবে । আর সে কারণে প্রণোদনার অর্থ হাতছাড়া না করতেই দেশবাসীকে ঝুঁকির মুখে ফেলে গার্মেন্ট খোলার এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার ফায়দা লুটতে মালিকরা শ্রমিকদের গরু-ছাগলের মতো টেনেহিঁচড়ে কারখানায় নিয়ে আসছে। এই টাকা অসাধু ব্যবসায়ীরা ভাগাভাগি করে খাবে। তিনি গরিব শ্রমিকদের বাড়ি ভাড়া মওকুফ, বকেয়া বেতন পরিশোধ করার দাবি জানান। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত এই টাকা যথাযথভাবে বণ্টনের দাবি জানান। এই শ্রমিক নেতা অভিযোগ করে বলেন, অনেক কারখানা ঘোষণা ছাড়াই নির্বিচারে ছাঁটাই করছে।’

দেশকে গার্মেন্টস মালিকদের এই লোভের খেসারত দিতে হতে পারে যেভাবে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেছেন, এই ছুটির সময়ে গার্মেন্টসকর্মীরা গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কেউ সংক্রমিত হয়েছেন কিনা, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। তারা আজকে ঢাকায় ফিরেছেন। কীভাবে এসেছেন, গণপরিবহনে এসেছেন কিনা, এদের মধ্যে কেউ সংক্রমিত হয়েছেন কিনা- সেটি আমরা জানি না। যদি কেউ সংক্রমিত থাকেন, তা হলে তিনি ভাইরাসটি অন্যদের মধ্যে ছড়াবেন।

করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে সরকার গঠিত পর্যালোচনা ও সমন্বয় কমিটির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বলেন, শ্রমিকরা যেভাবে দলে দলে ফিরছেন, এতে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। তারা গার্মেন্টসের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কাজ করবেন, এটা ঠিক কিন্তু এরই মধ্যে জনসমাগমের কারণে কোনো সংক্রমণ হলে সেটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিডিএফের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডক্টর মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, এ মুহূর্তে অবশ্যই কারখানাগুলো বন্ধ রাখা উচিত। এই শ্রমিকদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে।

এই গবেষক তিনটি কারণ উল্লেখ করে বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন মালিকরা ইচ্ছে করলে মোবাইলে অথবা ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দিতে পারত তাহলে শ্রমিকরা এভাবে ছুটে আসত না।

দ্বিতীয়ত, এ সময়ে কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছিল সমুচিত। যদিও কোনো কারখানায় অর্ডার থেকে থাকে তাহলে বায়ারদের সঙ্গে কথা বলে সরকারের ঘোষিত ছুটি সময়ের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কারখানা বন্ধ রাখতে পারত। ক্রেতাদের বুঝিয়ে বললে হয়তো তারা শুনতে। এখন যে পণ্যগুলো তারা নেবে সেগুলো এখনই তারা বিক্রি করবে না স্টক করে রাখবে।

তৃতীয় কারণ হিসেবে বলেন, গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি অন্য মানুষদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মতোই। বরং তাদের ঝুঁকি আরও বেশি কারণ তারা গা ঘেঁষে অল্প জায়গার মধ্যে অনেকে কাজ করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মাসখানেক ধরে কয়েক লাখ প্রবাসী বাংলাদেশে ফিরেছেন। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন আছেন। আক্রান্ত হয়ে মারাও গেছেন অনেকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারাদেশ লকডাউন না করে উল্টো গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢাকায় ফেরার দৃশ্য কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা ধারণাও করা যাচ্ছে না। অবহেলার কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও স্পেনের মতো উন্নত দেশ চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। ওই ধরনের অবস্থা হলে আমাদের দেশের লাখ লাখ লোকের বিনাচিকিৎসায় মৃত্যু ঘটবে।