কোম্পানীগঞ্জে ওসির ইশারায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন

কোম্পানীগঞ্জে ওসির ইশারায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জে পরিবেশ ধ্বংস করে গভীর রাত পর্যন্ত অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের মচ্ছব চলছে। হাজার হাজার শ্রমিক একত্রিত হয়ে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিও দেখা দিয়েছে। পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে শ্রমিকদের দিয়ে পাথর উত্তোলন করাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

আর এসব অপকর্মে সরাসরি জড়িত কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সজল কুমার কানু। লাইনম্যান নিযুক্ত করে তিনি টাকার বিনিময়ে পাথর উত্তোলন ও ভারতীয় গরুসহ বিভিন্ন পণ্য অবৈধভাবে দেশে আনার সুযোগ দিচ্ছেন। লাইনম্যানকে ফোন করে বোমা মেশিন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করার ইশারাও তিনি দিচ্ছেন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। লাইনম্যানের সঙ্গে ওসি কানুর কথোপকথনের একাধিক অডিওক্লিপ যুগান্তরের হাতে এসেছে।

জানা গেছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে কয়েকদিন ধরে প্রায় দুই হাজার শ্রমিক লিস্টার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ ১০ নম্বর এলাকা, ধলাই ব্রিজের নিচ, হাজির দাইন্যা, লালপাথর, উৎমাছড়ার মাঝেরগাঁও ও শাহ আরেফিন টিলা এলাকায় পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। পাথর উত্তোলনের নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। পুলিশকে ম্যানেজ করে তারা প্রকাশ্যে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছে।

কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে ভারতীয় গরু দেশে আনা নিয়ে ৩১ মার্চ যুগান্তরে ‘কোম্পানীগঞ্জ সীমান্ত : গরু পাচার নিয়ে ওসি-লাইনম্যান কথোপকথন’ শিরোনামে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ ঘটনা তদন্তে ওইদিনই জেলা পুলিশ দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। মঙ্গলবার তদন্ত কমিটি লাইনম্যান তোফায়েল ও নিজামকে ডেকে লিখিত জবানবন্দি গ্রহণ করে। সংবাদ প্রকাশের পর কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি কানুর কথোপকথনের আরেকটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। অডিও ক্লিপটির সূত্র ধরে ফের অনুসন্ধান শুরু করে। নানা অনৈতিক কাজে টাকার বিনিময়ে ওসির সংশ্লিষ্টতার একাধিক অডিও ক্লিপ অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে। এসব অডিও ক্লিপে ওসি কানুর সব অপকর্মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অভিযোগ- প্রতিটি কোয়ারিতে রয়েছে ওসির লাইনম্যান বাহিনী আর তাদের তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয় ওসির বিশ্বস্ত পুলিশ সদস্যদের। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সবকিছু অস্বীকার করে কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি সজল কুমার কানু বলেন, ‘এসবের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অডিও ক্লিপগুলোর ব্যাপারে আমি অবগত নই। হয়তো এগুলো ষড়যন্ত্রমূলকভাবে চায়না মোবাইল দিয়ে কেউ তৈরি করেছে। এ সব বিষয়ে আমি কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলিনি।’

ওসি কানু ও লাইনম্যান তোফায়েলের কয়েকটি অডিও ক্লিপ সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।

কথোপকথন-১- তোফায়েল : হে আদাব স্যার। ওসি : তোরার এদিকে আজকে অভিযান নাই, আজকে অভিযান হইলো শারফিনে। তোফায়েল : সব মেশিন বন্ধ (পাথর উত্তোলনের জন্য ছোট বোমা মেশিন বা লিস্টার মেশিন) করে লাইছে, মাত্র তিনটা গাত চলতেছে মানুষে মেশিন খুলিয়া বাড়িতে নিছে গিয়া। ওসি : লাগাউ সারারাত চালাউ কোনো সমস্যা নাই। তোফায়েল : হাসি... সারারাত তো চালানো যায় না স্যার। ওসি : চালাউ চালাউ। তোফায়েল : আইচ্ছা স্যার।’

কথোপকথন-২- ওসি : আজকে কত হইছে রে ‘কালেকশন’ (কোয়ারি থেকে চাঁদার টাকা)? তোফায়েল : আজকে স্যার ৭ হাজার টাকা হইছে। ওসি : কেন? তোফায়েল : টাকা লওয়া গেছে না তো স্যার, সব বন্ধ কইরা দিছে, আমরা তো মানে ৯টার ভিতরে ইয়ে করি, আমি বারনির (বের) আগেই মানষে মেশিন-টেশিন বন্ধ কইরা দিছে খালি একটা চলছে জমশেদে একটা চলছে তোমার হাবিবের আর এমনে ইয়া আছে নদীর ঐ পারে চলছিল ঐ। ওসি : প্রত্যেকটা গাতের (পাথর উত্তোলনের জন্য গর্ত) ম্যানেজার আছে না? তোফায়েল : জি জি স্যার। ওসি : তোরা ম্যানেজারের নাম আর মোবাইল নাম্বারটা নিবে ঠিক আছে। তোফায়েল : জি স্যার। ওসি : আর কালেকশনের সময় টাকা আর ম্যানেজারের নাম লিখে আনবে। তোফায়েল : জি স্যার। ওসি : ঠিক আছে, কোয়ারি তো দুইজন থেকে তিনজন (মালিক) মিলে লেখার দরকার নাই, ম্যানেজারের নাম আর মোবাইল নাম্বারটা লিখে আমারে আলাদা একটা তালিকা দিছ। তোফায়েল : জি স্যার। ওসি : আর নাম লিখার সময় ম্যানেজারের নাম লিখবি, অন্য কোনো পার্টনারের নাম লেখার দরকার নাই। তোফায়েল : আচ্ছা স্যার, ঠিক আছে স্যার। ওসি : ওকে ঠিক আছে।’

কথোপকথন-৩ তোফায়েল : ‘আদাব স্যার। ওসি : আজমল অউতার (কোয়ারি গর্ত মালিক) ফেলুডার (পাথর উত্তোলনের কাজে অবৈধ দানব যন্ত্র) কিতা দুইটা? তোফায়েল : জি না স্যার, একটা তো আমি তো আছি গাথর পাড়ও। ওসি : হে, দুইটা দেখা যায় বুঝি একটা দাঁড়াইয়া আছে আরেকটায় কাজ করে বুঝি? তোফায়েল : জি না স্যার আমি তো গাথর পার স্যার একটাই তো চলতাছে আমি নু কইলাম দাদারে সকালে ফোন দিয়া। ওসি : আইচ্ছা। তোফায়েল : আইচ্ছা স্যার।

কথোপকথন-৪ ‘ওসি : গত মাসে (প্রতি মাসে চুক্তিতে বাজার লিজ দেয়ার অভিযোগ আছে নিদিষ্ট টাকার বিনিময়ে) তরে কিতা কইছলাম গায়ে লাগে নাই। শাহিন (বড় পুঞ্জি মাদক বাজারের লাইনম্যান) কিতা সেট হয়ে গেছে না কিতা, শাহিনে? তোফায়েল : সেট না তো বুঝেন না অবস্থা, স্যার কি বলব স্যার? ওসি : আমি থানচিরি (উপজেলার সীমান্তের মাদক বাজার) বিষয় নিয়েও কথা আছে তোমার এগুলো নিয়ে কথা আছে। কারণ তোদের কথা আর কাজে মিলছে না, কাজ আর কথা কিন্তু মিলতেছে না ঠিক আছে। অনেক বিষয় আছে তদের নিয়ে বসে সম্ভবত আলাপ করতো হইব। তোফায়েল : আইচ্ছা ঠিক আছে স্যার।’

কথোপকথন-৫ ‘ওসি : ওয় গরুর ইয়ে টাকা লইয়া... টাকা আনছ না কিতা তুই? তোফায়েল :জি স্যার ১১টা গেছে বুঝছইননি। এগুলা ইয় অইব স্যার, দেয়া জাইব টাকা। ওসি : তুই বাসাত আয় বাসাত, একলানি? তোফায়েল : জি জি, জি স্যার। ওসি : আইয়ো বাসাত আইয়ো।’সূত্র : যুগান্তর

এমজে/