ভাঙছে ২০০ বছরের ঐতিহ্যর রীতি

শোলাকিয়ায় এবার দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামায়াত হচ্ছে না

শোলাকিয়ায় এবার দেশের সর্ববৃহৎ ঈদের জামায়াত হচ্ছে না

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবার কিশোরগঞ্জে শোলাকিয়ায় ঐতিহ্যবাহী দেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হবে না। শুক্রবার (১৫ই মে) এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক সারওয়ার মোর্শেদ চৌধুরী।

এর আগে, ঈদ জামাতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে আলেম-ওলামাদের সঙ্গে বৈঠক করে ধর্ম মন্ত্রণালয়। বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে এবার উন্মুক্ত স্থান ঈদের জামাত হবে না। আসন্ন ঈদ উপলক্ষে স্থানীয় প্রশাসনও সেই আলোকে শোলাকিয়ায় জামায়াত অনুষ্ঠানের কোনো প্রস্তুতি নেয়নি। ১৮০৪ সালে শুরুর পর এবারই প্রথম ঈদ জামাত হচ্ছে না ঐতিহাসিক শোলাকিয়ায়।

জেলা প্রশাসক বলেন, এবার ঈদ জামাত উন্মুক্ত স্থানে বড় জমায়েত পরিহার করতে নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। তাই ধর্ম মন্ত্রনালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বড় পরিসরে ও উন্মুক্তস্থানে ঈদের জামাত হবে না। সে অনুযায়ী শহরের বিভিন্ন মসজিদে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্য বিধি বজায় রেখে একাধিক জামাত অনুষ্ঠিত হবে।

এদিকে, বৃহস্পতিবার (১৪ মে) সন্ধ্যায় ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, খোলা ময়দানে ঈদের জামায়াত আয়োজন করা যাবে না। ঈদের জামাত হবে মসজিদে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে সামাজিক দূরত্ব। খতিব, ইমাম ও মসজিদ পরিচালনা কমিটিকে দেয়া ১৩ দফা নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, শিশু ও অসুস্থরা পারবেন না জামাতে অংশ নিতে। বিছানো যাবে না কার্পেট, ওযুর স্থানে রাখতে হবে সাবান, স্যানিটাইজার।

উল্লেখ্য, কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। প্রতিবছর এ ময়দানে ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদুল আযহা নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। কালের স্রোতে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানটি পরিণত হয়ে উঠেছে একটি ঐতিহাসিক স্থানে। এ ময়দানের বিশাল জামাত গৌরবান্বিত ও ঐতিহ্যবাহী করেছে কিশোরগঞ্জকে। বর্তমানে এখানে একসঙ্গে তিন লক্ষাধিক মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শুরুর আগে শর্টগানের ফাঁকা গুলির শব্দে সবাইকে নামাজের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সঙ্কেত দেওয়া হয়। কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্বে নরসুন্দা নদীর তীরে এর অবস্থান।

ইসলামের ঐশী বাণী প্রচারের জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে আগত শোলাকিয়া 'সাহেব বাড়ির' পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে ১৮২৮ সালে নরসুন্দা নদীর তীরে ঈদের জামাতের আয়োজন করেন। ওই জামাতে ইমামতি করেন সুফি সৈয়দ আহমেদ নিজেই। অনেকের মতে, মোনাজাতে তিনি মুসলি্লদের প্রাচুর্যতা প্রকাশে 'সোয়া লাখ' কথাটি ব্যবহার করেন। আরেক মতে, সেদিনের জামাতে ১ লাখ ২৫ হাজার (অর্থাৎ সোয়া লাখ) লোক জমায়েত হয়। ফলে এর নাম হয় ‘সোয়া লাখি’। পরবর্তীতে উচ্চারণের বিবর্তনে শোলাকিয়া নামটি চালু হয়ে যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, মোগল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমাণ ছিল সোয়া লাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়া লাখ থেকে সোয়ালাখিয়া- সেখান থেকে শোলাকিয়া। পরবর্তিতে ১৯৫০ সালে স্থানীয় দেওয়ান মান্নান দাদ খাঁ এই ময়দানকে অতিরিক্ত ৪.৩৫ একর জমি দান করেন।

বর্তমান শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের আয়তন ৭ একর। নরসুন্দা নদীর তীরে শোলাকিয়ার অবস্থান। এই ঈদগাহ মাঠটি চারপাশে উচু দেয়ালে ঘেরা হলেও মাঝে মাঝেই ফাঁকা রাখা হয়েছে যাতে মানুষ মাঠে প্রবেশ ও বের হতে পারে। এছাড়া এই মাঠের প্রাচীর দেয়ালে কোনো দরজা নেই। শোলাকিয়া মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫০০ করে মুসল্লি দাঁড়াবার ব্যবস্থা আছে। ফলে মাঠের ভেতর সবমিলিয়ে এক লাখ বত্রিশ হাজার ৫০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে ঈদুল ফিতরের সময় দেখা যায়, আশপাশের সড়ক, খোলা জায়গা, এমনকি বাড়ির উঠানেও নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এভাবে সর্বমোট প্রায় তিন লাখ মুসল্লি ঈদের নামাজ পড়ে থাকেন। এবং এই মুসল্লির এই সংখ্যা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে। শোলাকিয়া ঈদগাহ'র ব্যাবস্থাপনার জন্য ৫১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি রয়েছে। ঈদের নামাজের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিমূলক কর্মকান্ড এই কমিটি করে থাকে।