সিডরের চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসছে আম্পান

সিডরের চেয়েও বেশি শক্তি নিয়ে ধেয়ে আসছে আম্পান

ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বাতাসের বেগে আম্পান যখন বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানবে তখন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ থেকে ১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে আবহওয়া অফিস৷

এরই মধ্যে আম্পান আরো শক্তি সঞ্চয় করে ‘সুপার সাইক্লোন’ এর রূপ নিয়েছে৷ স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৮১০ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৬৫ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে; মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থান করছিল৷ এটি আরো উত্তর-উত্তর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে মঙ্গলবার শেষরাত থেকে বুধবার বিকাল বা সন্ধ্যার মধ্যে খুলনা ও চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে৷

সোমবার আম্পানের কেন্দ্রে বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাওয়ায় সেটিকে সুপার সাইক্লোন ঘোষণা করা হয়৷

আমফান এই শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রথম সুপার সাইক্লোন বলে জানান ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মৃত্যুঞ্জয় মহাপাত্র৷ সোমবার ফেসবুক লাইভে আম্পান নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি বলেন, ‘‘ভারত ও বাংলাদেশের ভূখণ্ডে উঠে আসার সময় আমফানের গতিবেগ কিছুটা কমবে৷ কিন্তু তারপরও সেটি সিডর ও আইলার চেয়ে বেশি বিধ্বংসী হতে পারে৷’’

আমফানের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোসহ দেশের বেশিরভাগ এলাকায় মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বৃষ্টি শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদেরা৷

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সাগর বিক্ষুব্ধ থাকায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরকে ৬ নম্বর এবং মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে৷

উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে বলে জানায় বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম৷

আগামী ২২ মে অমাবস্যা, যার টানে উপকূলীয় এলাকায় জোয়ারের পানির উচ্চতা বেশি থাকবে৷ ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং আশপাশের দ্বীপ ও চরের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-১০ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস৷

ভারতের আবহওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আম্পান বুধবার বিকালে উপকূল অতিক্রম শুরু করলে তখন ভাটার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস কিছুটা কম থাকবে৷ তবে সন্ধ্যায় জোয়ারের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাস হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর৷

বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর বলেছে, ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করার সময় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম জেলা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে৷ সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে৷

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস৷ ২০০৮ সালের মে মাসে যেটি মিয়ানমারে আঘাত হানে৷ এতে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ৷ ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়৷

এদিকে, সাগরে যখন ঘূর্ণিবায়ু পাক খাচ্ছে, ঢাকা, টাঙ্গাইল, মাদারীপুর, রাঙ্গামাটি, চাঁদপুর, মাইজদীকোর্ট, ফেনী, রাজশাহী, ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের দুয়েক জায়গায় তখন মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে৷ সোমবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে যশোরে ৩৭ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস৷

আবহাওয়াবিদ আরিফ হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের এ সময়ে বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকায় ভ্যাপসা গরমে অসহনীয় অবস্থা বিরাজ করছে সবখানে৷

‘‘তবে মধ্যরাত থেকে উপকূলীয় এলাকাসহ দেশজুড়ে বৃষ্টির প্রবণতা বাড়বে৷ যার প্রভাবে দিনের তাপমাত্রা ২-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমতে পারে৷’’

২০০৭ সালে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল ঘূর্ণিঝড় সিডর, তাতে তছনছ হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, প্রাণ হারিয়েছিল দুই হাজারের বেশি মানুষ৷ এক যুগ পর সেই একই অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসা আরেক ঘূর্ণিঝড় আমফান এখন সিডরের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে৷ বিধ্বংসী সিডির ‘সুপার সাইক্লোন' ছিল না৷

বঙ্গোপসাগরের জানা ইতিহাসে দ্বিতীয় সুপার সাইক্লোন আমফান৷ প্রথম সুপার সাইক্লোনটি ছিল ১৯৯৯ সালের উড়িষ্যা সাইক্লোন৷

ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ বিশ্লেষণ করে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে উপকূলে আঘাত হানলেও এ বিস্তৃতি থাকবে বাংলাদেশের হাতিয়া পর্যন্ত৷

সিডরের উৎপত্তি যেখানে ছিল, আম্পানের উৎপত্তিও বঙ্গোপসাগরের একই এলাকায়, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের কাছে৷ গত ডিসেম্বরে আঘাত হানা অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের মতোই এগোচ্ছে আমফান৷ গত বছরের মে মাসে আরেকটি শক্তিশালী ঝড় ফনীও একই পথে আঘাত হেনেছিল৷

সিডর আঘাত হানার সময় ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবন উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিল৷ বুলবুলের ক্ষেত্রেও ঢাল হয়ে ছিল সুন্দরবন৷

চলতি বছরের অক্টোবর মাসে ভারতের পশ্চিম উপকূলে আছড়ে পড়ে ঘূর্ণিঝড় মাহা ও ক্যার৷ এর আঁচ এসে পড়ে ভারত-বাংলাদেশ টি টুয়েন্টি ক্রিকেট সিরিজেও৷ বিজ্ঞানীরা জানান, ১৯৬৫ সালের পর এই প্রথম একসাথে দুটি ঘূর্ণিঝড় একসাথে অনুভব করছে ভারত৷ 

জয়েন্ট টাইফুন ওয়ার্নিং সেন্টার আমফানের সম্ভাব্য যে গতিপথ দেখিয়েছে, তাতে উপকূল অতিক্রম করার সময় এ ঝড়ের কেন্দ্র বা চোখ থাকতে পারে সুন্দরবনের ওপর৷

বন অধিদপ্তরের (বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চল) বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, ‘‘এবারের সুপার সাইক্লোনের প্রভাব সুন্দরবনেও পড়বে৷ আমরা এর মধ্যে সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট এলাকাসহ সবাইকে নিরাপদে অবস্থান নেওয়ার জন্যে সতর্ক করে দিয়েছে৷ মৎসজীবী ও বনজীবীদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার জন্যে বলেছি৷’’

মানুষের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেলেও বনের ক্ষয়ক্ষতি ঝড় থেকে এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না বলে মন্তব্য করেন তিনি৷