‘সরকার কোন ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না’

‘সরকার কোন ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না’

লকডাউন ইতিমধ্যেই দু’মাস অতিক্রান্ত। মহামারির থাবা ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে। করোনা পরবর্তী পৃথিবী কেমন হবে? আমাদের সামনে আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো কি? এমন বেশকিছু জিজ্ঞাসার খোলামেলা জবাব মিলেছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. (অব.) ড. এম. সাখাওয়াত হোসেনের কাছ থেকে।

গণমাধ্যমের প্রশ্নে প্রধানতম চারটি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। ভেঙে পড়া অর্থনীতি, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাত, জাতীয় নিরাপত্তা ও সমাজ জীবনই চ্যালেঞ্জের মূল ক্ষেত্র হবে বলে মনে করেন সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা।

বর্তমান পরিস্থিতির মূল্যায়ণ করতে গিয়ে এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্যানডেমিক বা মহামারি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এর নানামুখি প্রভাব বিশ্বজুড়েই পড়বে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সামাজিক, রাজনৈতিক, অথনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে আমরাও সম্পৃক্ত। বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশও এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে বের হতে পারবে না। করোনাকালীন ও করোনা পরবর্তীতে দেশের সামনে কোভিড-১৯ বেশকিছু চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে অর্থনীতি। এতদিন যে প্রবৃদ্ধির কথা আমরা শুনে আসছি তা ধরে রাখা সম্ভব হবে না। লকডাউনের দু’মাসের মাথাতেই আমরা দেখলাম বাজার অর্থনীতিতে ধ্বস। প্রচুর মানুষ বেকার হবে বা হচ্ছে। যে শিল্পগুলো বেশিরভাগ মানুষকে চাকুরি দিতো, বিশেষত পোষাক খাত সেখানে বড় রকমের ধ্বস নেমেছে।

মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গেও বিশ্ব অর্থনীতির যোগসূত্র আছে। এই দুঃসময়ে সার্ভিস সেক্টর বা সেবাখাতে দারুণ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যানবাহন চলাচল দু’মাস ধরে বন্ধ থাকায় এ খাতের শ্রমিকদের দেশজুড়ে সেবা দেয়া বন্ধ এবং আয়ও বন্ধ রয়েছে। দ্বিতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। সার্বজনীন পাবলিক হেলথ, জনস্বাস্থ্য বা গণস্বাস্থ্যের ব্যবস্থাপনা একেবারেই ভেঙে পড়েছে। এটা যেমন একজন নাগরিকের সুরক্ষা বা নিরাপত্তার দিক অন্যদিকে সমষ্টিগতভাবে জাতির নিরাপত্তাও। আমরা যদি আমাদের ওয়ার্ক ফোর্স বা জাতীয় অর্থনীতির চালিকা শক্তি শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত সকলকেই স্বাস্থ্য নিরাপত্তা না দিতে পারি সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। যা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এতদিন সরকার উন্নয়ন উন্নয়ন বলতে কেবল মেগা প্রজেক্টের কথাই বলেছে তা বর্তমান পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান। আসলে যে সকল জায়গাগুলোতে উন্নয়ন দরকার সে সকল ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়েছে।

আমরা দেখছি এসকল ঘাটতির ফলে মহামারির যে প্রকোপ তা সামলাতে পারছে না রাষ্ট্র। কাজেই এই খাতের যে দুরবস্থা তা নিশ্চিতভাবেই গুড গভর্ন্যান্সের ওপর দারুণভাবে প্রভাব ফেলে এবং এটা বিভিন্ন সেক্টরে যে সুশাসনের অভাব তার সাক্ষ্য দেয়। যেমন, ত্রাণ বিতরণে যে ধরণের দুর্নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে তা সুশাসনের অভাবেই হচ্ছে। তৃতীয় চ্যালেঞ্জ দেখছি যে ধরণের সামাজিক পরিবর্তন আসছে তা। করোনার ফলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে। যখন অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না, বেকারত্ব বাড়বে তখন সামাজিক অস্থিরতাও বাড়বে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে অস্থির হয়ে উঠবে রাজনীতিও।

প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে কোনও প্রতিবাদ নেই; বিরোধীদল নেই তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে কেন? সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি যোগসূত্র আছেই। সেখানে বিরোধীদল থাকুক আর না থাকুক। করোনা পরবর্তীতে বিশ্ব আর আগের অবস্থায় ফিরছে না।

সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা একটি সামাজিক অবক্ষয় দেখছি। রোগিরা হাসপাতালে যেতে পারছে না কারণ, রোগিদের হাসপাতাল গ্রহণ করছে না। অথচ এদের বিরুদ্ধে সরকার বা মন্ত্রণালয় দৃশ্যমাণ কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। লকডাউন নিয়ে যা হয়েছে তা লক্ষ্য করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। প্রতিটি বিষয়ে একবার ‘হ্যাঁ’ আবার একবার ‘না’ চলছে। সরকার বা কর্তৃপক্ষ কোনও সিদ্ধান্তই দৃঢ়ভাবে নিতে পারছে না। এটা দারুন একটি দুর্বলতা। এ ধরণের পরিস্থিতিকে অর্গনাইজেশনাল উইকনেস বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে দোদুল্যমানতা অথবা দুর্বলতা বলা যায়। এতে প্রমাণিত হয় সরকার কোন কিছুই সঠিক পরিকল্পনামাফিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। পুলিশ বলছে এক কথা আবার মন্ত্রণালয় বলছে আরেক কথা। সবশেষ ঘটনায় একবার মানুষকে ঈদে বাড়ি যেতে দেয়া হবে না বলা হলে সাধারণত মানুষ হেঁটে বাড়ি গেছে। এখন বলা হচ্ছে প্রাইভেট কারে যাওয়া যাবে। এই মানুষগুলো যে রোগ ছড়াবে তা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে সরকার।

তিনি বলেন, সবশেষ চ্যালেঞ্জ হবে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। ইতিমধ্যেই চীনের সঙ্গে আমেরিকা ও তার মিত্রদের মুখোমুখি দ্বন্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত চীনের সঙ্গে লাদাখ ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে আছে। অন্যদিকে চীনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য ভারতকে উস্কানি দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অপরদিকে সাউথ চায়না সি-তে আমেরিকা এবং চীনের নৌ বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। উপমহাদেশের দিকে তাকালে লক্ষ্য করা যাবে, নেপাল এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্কে তিক্ততা চলছে। নেপাল তার নতুন যে সীমানা দেখিয়েছে তাতে ভারতের দাবিকৃত জায়গা অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে টাগ অব ওয়ার বা রশি টানাটানি চলছে। এখানেও চীনের সঙ্গে ভারতের যে দ্বন্ধ তারই একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বে আরাকান রাজ্য উত্তপ্ত হয়ে উঠছে; যেখানে আমরা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাবার চেষ্টা করছি সেখানে আরাকান আর্মি বলে যে সংগঠন শক্তি সঞ্চয় করছে তার পেছনে বাংলাদেশের পরোক্ষ ইন্ধন আছে বলে মিয়ানমার দাবি করেছে। মিয়ানমারসহ বেশকিছু তথ্যে প্রকাশ হয়েছে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা ব্যবহার করে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের দক্ষিণাংশ দিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আরাকান আর্মির হাতে গেছে। দাবি করা হচ্ছে, এসব অস্ত্র চীনে তৈরি। উত্তর আরাকানে তুমুল লড়াই চলছে। লড়াই দমনে যেখানে মিয়ানমার আর্মি হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে।

অভিযোগ আছে, আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি) নামক সংগঠনের সঙ্গে আরাকান আর্মির একটি যোগসূত্র তৈরি হয়েছে। আরসা’র শক্তি সঞ্চয়ের পেছনে বাংলাদেশের পরোক্ষ ইন্ধন আছে বলেও অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমারের। বিবাদমান এই চ্যালেঞ্জগুলো করোনাকালীন ও করোনা উত্তর সময়ে বাংলাদেশকে মোকাবিলা করতে হবে। ভারত-চীনের এই দ্বন্ধ এবং এর সঙ্গে চীন আমেরিকার দ্বন্ধ যদি ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশি হিসাবে বাংলাদেশেও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এর প্রভাব পড়বে।