‘অসহায়ভাবে ইউনাইটেডের করোনা ইউনিটে বাবাকে পুড়ে যেতে দেখেছি’

‘অসহায়ভাবে ইউনাইটেডের করোনা ইউনিটে বাবাকে পুড়ে যেতে দেখেছি’

হাসপাতালে আগুন লাগার প্রায় চার ঘণ্টা আগে জানতে পারেন, তিনি করোনা আক্রান্ত নন। রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ এসেছে। তাকে হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু, তার আগেই বাবাকে চোখের সামনে আগুনে পুড়ে যেতে দেখেন ছেলে আন্দ্রে ডমিনিক পাল।

চট্টগ্রামের এই প্রকৌশলী বলেন, ‘আমার বাবা নিউমোনিয়া নিয়ে গত ২৫ মার্চ ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন। ১৭ তারিখ তিনি গোসল করার সময় স্ট্রোক করেছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টার মতো তিনি বাথরুমের ভেজা মেঝেতে পড়ে ছিলেন।’

‘আমরা বিষয়টি বুঝতেও পারিনি। এক ঘণ্টা পর তার জ্ঞান ফেরে। বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে তিনি আমাদেরকে জ্ঞান হারানোর কথা জানান। কী হয়েছিল তা তিনি বলতে পারছিলেন না। কিন্তু, ভেজা মেঝেতে অনেকক্ষণ পড়ে থাকার কারণে আমাদের সন্দেহ হয় তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।’

আইইডিসিআরের করোনার রিপোর্টে নেগেটিভ আসার পরেও নিউমোনিয়ার লক্ষণ থাকার কারণে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়নি। এর মধ্যেই দ্বিতীয়বারের মতো স্ট্রোক করেন তিনি।

আন্দ্রে বলেন, ‘অবশেষে, ইউনাইটেড হাসপাতাল তাকে ভর্তি করাতে রাজি হয়। শর্ত ছিল, তাকে আইসোলেশন ইউনিটে থাকতে হবে। আমরা তাদেরকে আইইডিসিআরের পরীক্ষার রিপোর্টটি দেখাই। কিন্তু তারা জানান যে, ত্রুটির কারণে রিপোর্টে “ফলস নেগেটিভ” আসতে পারে। আমরা ঝুঁকি নিতে রাজি হই। কারণ, একমাত্র ওই হাসপাতালই তাকে চিকিৎসা দিতে রাজি হয়েছে।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একইদিনে দ্বিতীয়বারের মতো তার করোনা পরীক্ষা করে। ২৭ মে আগুন লাগার কয়েক ঘণ্টা আগে পরীক্ষার রিপোর্ট আসে।

‘আমরা ল্যাবের প্রধানকে ফোন করে জানতে পারি, বাবা করোনা নেগেটিভ। বিকেল পাঁচটার দিকে আমরা হাসপাতালে যাই। বাবাকে সাধারণ ওয়ার্ডে স্থানান্তর করতে অনুরোধ করি। কিন্তু ডাক্তাররা জানান, রিপোর্টের কাগজ (হার্ড কপি) হাতে না আসা পর্যন্ত তাকে আইসোলেশন ইউনিটেই থাকতে হবে। স্থানান্তর করা যাবে না।’

এর পরের চার ঘণ্টা রিপোর্টের হার্ড কপি সংগ্রহের জন্য ছোটাছুটি করেন আন্দ্রে।

‘রাত সাড়ে নয়টার দিকে আমার স্ত্রী মোবাইলে বাবার জন্য একটি মেসেজ পাঠান। আমি আইসোলেশন ওয়ার্ডের বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন সেটা বাবাকে দেখাতে পারবো!’

ঠিক সেসময়ই হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখেন তিনি। ইউনিটটির নকশা এমন ছিল যে, প্রবেশের পর প্রথম রুমটিতে চিকিৎসকরা বসেন, দ্বিতীয় রুমটিতে রোগীদের রাখা হয়। রোগীদের রুমের ৩ নম্বর বিছানাটি ছিল ভার্ননের।

‘আমরা ভেতর থেকে তাদের চিৎকার শুনতে পাই। আমি এসিতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ডাকা হয়। কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। এক মিনিট পর আবারও এসিতে আগুনের স্ফুলিঙ্গ আরও ভয়ংকর রূপ নেয়।’

পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আন্দ্রেই আগুন কীভাবে ছড়ায় সে বিষয়ে জানেন।

তিনি বলেন, ‘ওই এসির ঠিক নিচে একটি খালি বিছানা ছিল। আমি দ্রুত তাদেরকে বিছানা সরিয়ে নিতে বলি।’

কিন্তু কেউ তার কথা শোনেননি। কর্মীরা সবাই বের হয়ে এল।

‘আগুনের ফুলকি মেঝে পর্যন্ত ছড়াতে থাকে। ওয়ার্ডের এক কর্মী একটা ভেজা মপ (স্পঞ্জযুক্ত ঝাড়ু) নিয়ে আগুন নেভাতে চেষ্টা করে। কিন্তু, সম্ভবত ওই মপে তরল জীবানুনাশকও ছিল। ফলে পুরো মেঝেতে আগুন লেগে যায়।’

আগুনের শিখা বাড়তে দেখে ওয়ার্ড কর্মী মপ ফেলে ছুটে বের হয়ে আসেন।

ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স বিভাগ জানায়, সাড়ে নয়টার সময় আগুন লাগে।

ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, আগুনটি একটি শর্ট সার্কিট থেকে উদ্ভুত হয় এবং “বাতাসের কারণে দ্রুত” ছড়িয়ে পড়ে।

‘আমি তখন চিৎকার করছিলাম। বলছিলাম, “আমার বাবা ভেতরে আছেন। কেউ দয়া করে কিছু করুন।” আমি ভাবছিলাম, ভেতরে যেতে হবে। কিন্তু কীভাবে? পুরো জায়গাটা তখন কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলছে। হয়তো আমার বাবা আমাদেরকে ডাকছিলেন। কিন্তু, আমরা যেতে পারিনি।’

তার ভগ্নিপতি সেসময় দ্রুত হাসপাতালের আগুন নেভানোর যন্ত্র নিয়ে আসেন।

‘আমি হাসপাতালের জরুরি আগুন নেভানোর যন্ত্র নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। বাবাকে বের করে আনতে চেষ্টা করি। কিন্তু আগুন তখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।’

‘যখন তারা একের পর এক মরদেহ বের করে আনছিলেন। আমি মরদেহগুলোর দিকে ছুটে যাচ্ছিলাম, চাদর সরিয়ে সেগুলো দেখছিলাম। দেহগুলো এতো বেশি পুড়ে গেছে যে বাবার মরদেহ শনাক্ত করতে আমাদের অনেক সময় লেগেছে। আমি জীবনে প্রথম অগ্নিদগ্ধ কোনো মরদেহ দেখলাম।’

মরদেহের বুকে পেসমেকার (হৃত্স্পন্দন নিয়মিত রাখার জন্য কৃত্রিম বৈদ্যুতিক যন্ত্রবিশেষ) দেখে বাবাকে চিনতে পারলেন আন্দ্রে।

তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম একটা দেহের পেসমেকার পুড়ে গেছে।’

চিৎকার করে কেঁদে উঠেন তিনি, ‘হ্যাঁ এটাই আমার বাবা। যখন তিনি বেঁচে ছিলেন, তার মাথা ভর্তি চুল ছিল। তার গোঁফ ছিল। আমি দেখলাম তার পুরো চেহারা পুড়ে কালো হয়ে গেছে।’

যন্ত্রণায় ভাঙা কণ্ঠস্বর নিয়ে প্রতিবেদককে বলছিলেন তিনি।

‘আমি নিজের বাবার পোড়া দেহের গন্ধ কিছুতেই মাথা থেকে বের করতে পারছি না।’

ভার্নন আন্থনী পাল ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিমানবাহিনীতে কাজ করতেন। পাকিস্তানের কোয়েটায় যুদ্ধবন্দি ছিলেন। মুক্তি পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি। একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে জীবন কাটান।

ডিএইচএল থেকে তিনি ২০০৩ সালে অবসরে যান।

গতকাল তিনি স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে রেখে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।সূত্র : দ্যা ডেইলি স্টার

এমজে/