করোনা মহামারিতেও বাংলাদেশে থেমে নেই মানবাধিকার লংঘন: রিপোর্ট

করোনা মহামারিতেও বাংলাদেশে থেমে নেই মানবাধিকার লংঘন: রিপোর্ট

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারিতেও বাংলাদেশে থামছেনা মানবাধিকার লংঘন। কোনো ধরনের চিকিৎসা ছাড়াই মানুষ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ছে, ক্ষুধার তাড়নায় রাস্তায় বের হয়ে বিক্ষোভ করছে, সংকট আর অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে পোশাক-পরিবহন কর্মী থেকে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ।

শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক রিপোর্টে মহামারির মুহূর্তে বাংলাদেশে মানবাধিকারের এ বেহাল দশার চিত্র তুলে ধরেছেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, পেশাজীবিদের সমন্বয়ে গঠিত এক সাংগঠনিক প্ল‌্যাটফর্ম। ১১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ১৯ টি সংবাদপত্র এবং ৫ টিভি চ্যানেলে প্রকাশিত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে মানবাধিকার লংঘনের এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়।

সংগঠনের উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন- আলোকচিত্রী শহীদুল আলম, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবি জ্যোর্তিময় বড়ুয়া, নারী মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আকতার, গবেষক সাদিয়া গুলরুক, রেজাউর রহমান লেনিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগি অধ্যাপক মইদুল ইসলাম।

রিপোর্টে বলা হয়, "৪১ জেলাতে অন্তত ১২২ জন লোক চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছেন। মূলত চারটি প্রধান কারণে এমনটা ঘটছে- হাসাপাতালগুলো রােগী ভর্তি করছেনা, যারা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে তারা কোনো সেবা পাচ্ছেনা, ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা এবং কেউ চিকিৎসা নিতে চাইলে তাতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে রোগীর আত্মীয়-স্বজন, সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল নেতারা এবং প্রতিবেশী।"

এতে বলা হয়, "গত ২৪ এপ্রিল রনিকা চাকমা নামের এক আদিবাসি প্রসব বেদনা নিয়ে রাঙ্গামাটির একটি হাসপাতালে যাবার মুহূর্তে তিনি যে লঞ্চে চড়েছিলেন তা রাত ৩.১৫ মিনিটে তল্লাশির জন্য ৪৫ মিনিট থামিয়ে রাখে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। যখন রনিকার অবস্থা চরম অবনতির দিকে চলে যায় তখনি লঞ্চটি ছাড়ার অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু হাসপাতালে নেয়ার পর আগন্তুক শিশু এবং মা দুই জনই মারা যায়।"

মহামারিতে চরম ঝুঁকিতে পড়েছেন সম্মুখ সারির স্বাস্থ্যকর্মীরা উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই।এমনকি মিডিয়ায় কোনোধরণের কথা বলতেও তাদেরকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। গণমাধ্যমে কথা বলতে গিয়ে কী রকম বিপদের মুখে পড়েত হয়েছে তারাে বর্ণনা রিপোর্টে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে।

প্রতিটি সেক্টটরের কর্মজীবি মানুষদের দুরবস্থার চিত্র উঠে এসেছে রিপোর্টটিতে। এতে বলা হয়, "ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মে পর্যন্ত প্রতিদিনই পোশাক শ্রমিকদের দেখা গেছে রাস্তায় নেমে বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করতে। অথচ যখন সারাদেশে লকডাউন দেয়া হলো কোনাে কারখানা তখনো লকডাউন করা হয়নি। ৭ মে পর্যন্ত ৯৭ জন পোশাক শ্রমীক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।"

আশুলিয়ার শ্রমিক সংগঠকরা অভিযোগ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে ফোন করে এই বলে সতর্ক করেছেন যে- বেতন বকেয়ার বিষয় নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু লেখা যাবেনা। রিপোর্টে বলা হয়, আশুলিয়া শিল্প পুলিশ ৫ শ্রমিক নেতাকে আটক করে নিয়ে সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এবং তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনোকিছু লিখবেনা এমন অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর নিয়ে তাদের থানা থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।

রিপোর্টে বলা হয়, মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় যেসব চা শ্রমিকরা দিনে ১০২ টাকায় কাজ করে ১২ সপ্তাহ ধরে বকেয়া রাখা হয়েছিলো তাদের পাওনা।

সারাবছর ধরে বিভিন্ন নামে-বেনামের সংগঠনকে চাঁদা পরিশোধ করে আসলেও বিপদের সময়ে তা কোনো কাজে আসেন অভুক্ত পরিবহন শ্রমিকদের। ৩০০ টির মতো সংগঠন বছরে চাঁদা থেকে ২০০০ কোটি টাকা আয় করলেও প্রায় ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিক সেখান থেকে কোনো সুবিধা পায়নি।

এতে বলা হয়, "শ্রমিক কল্যাণ সংগঠন বিগত বছরগুলোতে শ্রমিকদের থেকে ৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করলেও সেখান থেকে কোনো টাকা ত্রাণ সহায়তায় কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়।"

গত ১৬ এপ্রিল যেসব আদিবাসি শ্রমিকরা লকডাউনে তাদের কর্মসংস্থান হারিয়ে ফেলেছিলো তারা যখন বাড়ি ফিরতে চায় তখন খাগড়াছড়া-ফটিকছড়ি সীমান্তে তাদের আটকে দেয় আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যরা। এদের অধিকাংশ ছিলো মহিলা, তাদের দমাতে পুলিশের লাঠি চার্জে ৫ জন আহত হয়।

মহামারিতে ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকেরা। ৯৬ টি বেসকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিরা এপ্রিলে পুরো বেতন পেয়েছেন।

দেশের এ সংকটকালে যে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে তা খুবি ধীর এবং স্বল্প বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। ২৯ মার্চ থেকে ২৮ এপ্রিল এসময়ে ত্রাণের দাবিতে যশোরে ১২, ঢাকায় ১১, চট্টগ্র্রামে ৯, রংপুরে ৮, নীলফামারিতে ৭, গাইবান্ধায় ৭, পাবনায় ৬, রাজশাহীতে ৬, লালমনিরহাটে ৫, সিরাজগঞ্জে ৫, জামালপুরে ৪, পঞ্চগড়ে ৪, দিনাজুপরে ৪, ঠাকুরগাঁয়ে ৪ এবং বরিশালে ৪ টি বিক্ষোভ করেছে অসহায়-নিম্ন আয়ের মানুষ।

করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব পড়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের মধ‌্যেও উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়, "হঠাৎ করে চাকুরি হারানো এবং বাড়িতে টাকা পাঠাতে না পারার বিরুপ প্রভাব পড়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের উপর। কুয়েতের এক সংবাদপত্র জানিয়েছে অন্তত ৯ শ্রমিক আত্মহত্যা করেছে এবং চার জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো।"

জিএস/