পাঁচটি সফটওয়্যার খরচ ৫৫ কোটি টাকা ডা. ইকবাল কবিরের!

পাঁচটি সফটওয়্যার খরচ ৫৫ কোটি টাকা ডা. ইকবাল কবিরের!

দেশের স্বাস্থ্য খাত কতটা নড়বড়ে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পর তা উন্মোচিত হয়েছে। পর্যাপ্ত ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) অভাবে করোনায় আক্রান্ত রোগী মারা যাচ্ছে। নেই যথেষ্টসংখ্যক মানসম্পন্ন ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই)। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের অভাবে করোনায় আক্রান্তদের সেবা দিতে পারছেন না চিকিৎসকরা। এমন বাস্তবতায় বহুজাতিক সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে পিপিই, ভেন্টিলেটর, মাস্ক, গগলসসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এসব স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনায় যে খরচ ধরা হয়েছে, তা বর্তমান বাজারমূল্যের চেয়ে দুই থেকে চার গুণ বেশি।

এ ছাড়া চলমান মানবিক দুর্যোগের সময় যেখানে চিকিৎসা উপকরণের দিকে জোরালো নজর দেওয়া দরকার, সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশি ঝোঁক চিকিৎসাবহির্ভূত খাতে। চিকিৎসা সরঞ্জামে যত টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার চেয়ে তুলনামূলক বেশি টাকা খরচ হচ্ছে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে।

করোনা সংকট মোকাবেলায় স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে এখন পর্যন্ত জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় দুটি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১১৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ঋণ দিচ্ছে ৮৫০ কোটি টাকা। বাকি ২৭৭ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে এডিবির অর্থায়নে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে এক হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে এডিবির ঋণ ৮৫০ কোটি টাকা। বাকি ৫১৫ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। এরই মধ্যে দুটি প্রকল্পের কাজও শুরু হয়েছে। আর প্রকল্প দুটির পরিচালক (পিডি) অধ্যাপক ড. ইকবাল কবির, তাকে স্বাস্থ্য খাতের লুটপাটের জনক হিসেবে সবাই চিনে ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রকল্প দুটিতে আছে ব্যাপক ত্রুটিবিচ্যুতি। টাকা খরচের ক্ষেত্রে আছে দ্বৈততা। অর্থ অপচয়ের আছে প্রচুর সুযোগ। প্রকল্প দুটিতে যে খরচ দেখানো হয়েছে, তাতে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনও। কিন্তু তাতেও লাভ হয়নি। খরচ কমানো যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নেওয়া ‘করোনাভাইরাস মোকাবেলায় জরুরি সহায়তা’ শিরোনামের প্রকল্পটির আওতায় মাত্র ৩০টা অডিও-ভিডিও ফিল্ম তৈরির খরচ দেখানো হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ৮০টা সেমিনার ও কনফারেন্স করে খরচ করা হবে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি অস্বাভাবিক খরচ দেখানো হয়েছে ওয়েবসাইট উন্নয়ন খাতে। মাত্র চারটি ওয়েবসাইট উন্নয়ন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের খরচ হবে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পাঁচটি ডাটাবেইস তৈরিতে খরচ দেখানো হয়েছে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

পাঁচটি কম্পিউটার সফটওয়্যার কেনায় খরচ ধরা হয়েছে ৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া ৩০টি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য খরচ হবে আরো ৪৫ কোটি টাকা। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আনা-নেওয়ার জন্য গাড়ি ভাড়া নেওয়া হবে। সেই গাড়িভাড়া বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা।

বিশেজ্ঞরা মনে করেন, চলমান মানবিক দুর্যোগের সময় যেখানে চিকিৎসা উপকরণের দিকে জোরালো নজর দেওয়া দরকার, সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেশি ঝোঁক চিকিৎসাবহির্ভূত খাতে । চিকিৎসা সরঞ্জামে যত টাকা খরচ করা হচ্ছে, তার চেয়ে তুলনামূলক বেশি টাকা খরচ হচ্ছে সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাতে।এগুলো এই মুহুর্তে প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞরা। তারা মনে করেন জরুরী চিকিৎসা সামগ্রীর দিকে নজর দেওয়া উচিত, সফটওয়্যার, ওয়েবসাইট, সেমিনার, কনফারেন্স ও পরামর্শক খাত এগুলো স্রেফ লুটপাটের খাত,এছাড়া্ কিছুই না।

দেশে যতগুলো স্থলবন্দর আছে, সেখানে যাতায়াত করা মানুষের শরীরের তাপমাত্রা দেখতে নির্মাণ করা হবে অনাবাসিক ভবন। সেসব ভবন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ১৯০ কোটি টাকা।

এমন খরচের হিসাব দেখে বিস্মিত পরিকল্পনা কমিশনও। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিকালে প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদন দরকার, তাই চিকিৎসা সরঞ্জামের তুলনায় এসব খাত অনাবশ্যক হওয়া সত্ত্বেও প্রকল্পটি অনুমোদন করতে হয়েছে কমিশনের কর্মকর্তাদের।

এছাড়াও অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, প্রকল্পটির আওতায় এক লাখ সেফটি গগলস কেনা হবে। প্রতিটি সেফটি গগলসের দাম ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। মোট খরচ ধরা হয়েছে ৫০ কোটি টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে প্রতিটি সেফটি গগলস বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় মোট এক লাখ সাত হাজার ৬০০ পিপিই কেনা হবে। যার প্রতিটির জন্য খরচ ধরা হয়েছে চার হাজার ৭০০ টাকা। পিপিই কেনায় মোট খরচ হবে ৫০ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অথচ বর্তমান বাজারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সব শর্ত মেনে ওষুধ অধিদপ্তরের সব শর্ত অনুসরণ করে বিভিন্ন কম্পানির তৈরি ভালো মানের পিপিই বিক্রি হচ্ছে এক থেকে দুই হাজার টাকায়। এই প্রকল্পের আওতায় ৭৬ হাজার ৬০০ জোড়া বুট শু কেনা হবে। প্রতিটি শুর খরচ দেখানো হয়েছে এক হাজার ৫০০ টাকা। এই খাতে খরচ ধরা হয়েছে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। দেশে বর্তমান বাজারে বুট শু ৩০০ থেকে ৫০০ টাকায় মিলছে।

জানতে চাইলে বেক্সিমকো ফার্মার চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর বলেন, ‘জিএসএম ৭০’ পিপিই দেশের বাজারে এখন বিক্রি হচ্ছে এক হাজার টাকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ওষুধ অধিদপ্তরের সব শর্ত মেনেই মানসম্পন্ন পিপিই উৎপাদন ও সরবরাহ করছে বেক্সিমকো।

পিপিই ও গগলস উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সফট-বাংলার স্বত্বাধিকারী কুদরত এলাহী লিটন বলেন, প্রতিটি পিপিইর দাম এক থেকে দুই হাজার টাকার মধ্যে। এসব পিপিই আন্তর্জাতিক মানের। দুই হাজার টাকার বেশি কোনো পিপিই নেই। এ ছাড়া প্রতিটি ভালো মানের সুরক্ষা গগলস বিক্রি হয় ৫০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

এমজে/