নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন-মৃত্যু নিয়ে আসকের ৬ উদ্বেগ

‘মানুষের কণ্ঠরোধ হয়ে আছে, সাধারণ মানুষও ফেসবুক ব্যবহারে ভয় পাচ্ছে’

‘মানুষের কণ্ঠরোধ হয়ে আছে, সাধারণ মানুষও ফেসবুক ব্যবহারে ভয় পাচ্ছে’

নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর বিষয়ে ছয় ৬ দফা উদ্বেগ জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

শুক্রবার এক অনলাইন অলোচনায় (ওয়েবিনারে) তারা নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর বিষয়ে সাম্প্রতিক চিত্র তুলে ধরেন। ‘নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবস’ উপলক্ষে আলোচনায় আসক দাবি করে, ‘হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু আইন ২০১৩’ এর অধীনে এখনও পর্যন্ত কোনও মামলার সুরাহা হয়নি। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর অসংখ্য অভিযোগের বিপরীতে মামলা হয়েছে মাত্র ১৭টি। কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চারে সরকার প্রদত্ত হিসাব তুলে ধরে তারা এ উদ্বেগের কথা জানান।

আলোচনার শুরুতে এক উপস্থাপনায় আবু আহমেদ বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে ২০১৫ সালে হত্যার শিকার ১৮১ জনের মধ্যে ১১ জনের বিষয়ে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল। ২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ড ঘটে ১৮৫টি, এর মধ্যে ১০ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ সালে ১৫০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন, যার মধ্যে ১২ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ২০১৮ সালে এধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে ৪৬০টি, এর মধ্যে ৬ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ২০১৯ সালে ৩৭৬টি ঘটনায় ১২ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত ১৩৬টি ঘটনার মধ্যে ১১ জনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।’

উদ্বেগের কথা বলতে গিয়ে ছয়টি বিষয় উল্লেখ করা হয়, নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু আইন ২০১৩ এর অধীনে এখনও পর্যন্ত কোনও মামলার সুরাহা হয়নি। হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর অসংখ্য অভিযোগের বিপরীতে মামলা হয়েছে মাত্র ১৭টি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে মামলা করেন না। যারা সাহস করে মামলা করেন, তাদের নানা হয়রানি ও হুমকির মুখে পড়তে হয়। সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। বিভাগীয় ব্যবস্থা অধিকাংশ সময়েই কেবল অব্যাহতি বা বদলির মধ্যে সীমাবদ্ধ। নির্যাতন ও হত্যা বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ডিজিটাল নিরাপত্ত আইনের আওতায় অনেককে আটক করা হচ্ছে উচ্চতর আদালতের নির্দেশনা না মেনে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিষয়ে জানতে আইজিপি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নানা সময়ে চিঠি দিয়েও তারা কোনও জবাব পায়নি।

এর আগে আইনজীবী জেড আই খান পান্না স্বাগত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ‘নির্যাতন প্রতিরোধ দিবসে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি যে, গত এক-দুই বছর ধরে বিশ্বব্যাপী নির্যাতন বাড়তেই দেখা যাচ্ছে। এমন আর কখনোই হয়নি। ১৯৬২ সালের পরে আমেরিকার মতো মানবাধিকার নিশ্চিত করা শেষে এবার আবারও বর্ণবিদ্বেষী ভূমিকা দেখা গেলো। প্রতিবাদও গড়ে উঠলো। বিশ্বব্যাপী অরাজকতা চলছে।’

আইনি প্রতিকার প্রাপ্তিতে যে বাধা তৈরি হচ্ছে সে বিষয়ে আইনজীবী ও আসকের সদস্য আসাদুজ্জামান বলেন, ‘যে সময় অতিবাহিত করছি— নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। ডাটায় যেসব বেরিয়ে আসে সেসব দৃশ্যমান, কিন্তু অদৃশ্য মানচিত্র হলো মানুষের কণ্ঠরোধ হয়ে আছে। সাধারণ মানুষও ফেসবুক ব্যবহারে ভয় পাচ্ছে। ভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে না পারলে পরিস্থিতি বদলাবে না। তথ্যগুলো উপস্থাপন করতে পারছি একারণে যে, আসক কাজটি সাহসের সঙ্গে করছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে আর একটিও মামলা দেখতে চাই না। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের বেঁচে থাকার যে ন্যূনতম উপাদান, সেটি নিশ্চিত করা হোক।’

সাংবাদিক আবু সাঈদ খান স্বআরোপিত সেন্সরশিপের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘কেউ সারাক্ষণ কিছু নিষেধ করছে তা নয়। গণমাধ্যম নিজে থেকে চুপ থাকছে। এটার কারণ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে সমস্যা রয়ে গেছে। শুরু থেকেই সংবিধানে গণতন্ত্র সন্নিবেশিত। কিন্তু রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ন আমরা করতে পারিনি। আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন দুর্বল হয়ে গেছে। শক্তিশালী বিরোধীদলও মাঠে উত্তাপ থাকলে সংবাপত্রের স্বাধীনতা প্রসারিত থাকে।’