ফি নিয়ে করোনা পরীক্ষা, দরিদ্ররা পরীক্ষার বাইরে থাকলে সংক্রমণ বাড়বে

ফি নিয়ে করোনা পরীক্ষা, দরিদ্ররা পরীক্ষার বাইরে থাকলে সংক্রমণ বাড়বে

দেশের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত ফি নিয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের বুথগুলোতে এখনো ফি নেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। ফি নেয়ার বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই তাদের সরকারি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে করোনা পরীক্ষার জন্য কোনো ফি নেয় না। সরকারি পরিচালনাধীন পরীক্ষায় এ জাতীয় ফি আরোপ করা সারা বিশ্বেই বিরল। তারা বলছেন, এতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষতি হবে। গরীবরা বঞ্চিত হবেন। বাড়বে ভাইরাসটির সংক্রমণ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহারা বানু জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে গত ৩০শে জুন তাদেরকে সরকার নির্ধারিত ফিতে করোনার পরীক্ষার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী ওইদিন বিকালে তা শুরু হয়েছে। গতকাল দুপুর তিনটা পর্যন্ত ৮৯ জন ফি দিয়ে করোনার পরীক্ষা করাতে যান। আগেও তাদের এই সময় পর্যন্ত এরকম সংখ্যা ছিল। ফি নির্ধারণের কারণে পরীক্ষা কমা বা বাড়ার বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অন্যদিকে, বিএসএমএমইউ’তে এখনও সরকার নির্ধারিত ফিতে পরীক্ষা শুরু হয়নি। তবে আজ সভা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফি নেয়া শুরু করা হবে বলে জানান বিএসএমএমইউ’র ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুুয়া।

তিনি আরো জানান, বিএসএমএমইউতে সব সময়ে পরীক্ষার জন্য করোনার সন্দেহভাজন রোগীদের ভিড় থাকে। গতকালও ৫৬৫টি পরীক্ষা হয়েছে। ফি নির্ধারণের কারণে পরীক্ষা কমবে বলে মনে করছেন না তিনি।

ফি নির্ধারণের কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা এড়াতে এবং উন্নত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে’ এই ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ফি নির্ধারণের কারণে ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টায় একটি বাধা হিসেবে সামনে দাঁড়াবে। বিশেষ করে সমাজের দরিদ্র মানুষের যদি লক্ষণ দেখাও দেয় তাহলেও তারা সরকারি হাসপাতাল ও বুথগুলোতে পরীক্ষা করাতে পারবেন না। তারাই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে।

তারা বলেন, দেশ এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ভাইরোলজিস্টদের পরামর্শ অনুসারে অধিক পরিমাণে পরীক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। তবে বিশেষজ্ঞরা ‘অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা’ সম্পর্কিত সরকারের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, লক্ষণ দেখা দিলে বা ভয়ের কারণেই কেবল মানুষ হাসপাতালে এবং পরীক্ষার বুথে ভিড় করছে।

কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, এই প্রাদুর্ভাব রোধ করার মূল চাবিকাঠি পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা। তবে সরকার একটি বিপরীতমুখী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশ ফি নিচ্ছে, তা তার জানা নেই। এই সিদ্ধান্তের কারণে আমরা শুধু ধনীদের মধ্যে সংক্রমণের হার জানতে পারব। কারণ দরিদ্ররা পরীক্ষার জন্য ফি ব্যয় না করে সেই টাকা দিয়ে দুই কেজি আটা কিনে নেবে। ডাল কিনবে। ২০০ টাকা যাদের নেই, তারা পরীক্ষা করবেন না। বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা নিতে পারেন। কিন্তু লাইনে দাঁড়িয়ে যারা নমুনা দেবেন তারা কেন ২০০ টাকা দেবেন ? ফি নির্ধারণের কারণে গরীবরা বাদ পড়বেন। বড় একটা গ্রুপ বঞ্চিত হবেন। আর এতে সংক্রমণ ছড়াবে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নাগরিকদের কাছ থেকে কোনো দেশের সরকার অর্থ নেয় বলে আমাদের জানা নেই। এমনি সাধারণরা পরীক্ষা করাতে পারছে না। প্রভাবশালীরা প্রভাব খাটিয়ে পুরো পরিবার নিয়ে পরীক্ষা করাতে পারছেন। লাইনে দাঁড়িয়েও অনেক সাধারণ মানুষ পরীক্ষা করাতে পারছেন না। অপব্যবহার রোধ করতে গিয়ে উল্টো হয়ে যাবে। যাদের দরকার তারা আসবেন না। তাদের কাছে ২০০ বা ৫০০ টাকা অনেক।

তিনি আরো বলেন, এমনিই তারা মৃদু লক্ষণ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। টাকার কথা শুনে এখন আর বুথে আসবেন না। বাস্তবতা হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত প্রান্তিক মানুষদের পরীক্ষা করানো থেকে নিরুৎসাহিত করবে। গরিবরা ভাববেন এ রোগের চিকিৎসা নেই, টাকা দিয়ে পরীক্ষা করার পর চিহ্নিত হয়ে কোন লাভ নেই। এতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষতি হবে। এর ফলস্বরূপ ভাইরাসের সংক্রমণ আরো বাড়বে। করোনা পরীক্ষায় ফি নেয়ার ঘোষণা এমন সময় এলো যখন দেশে ক্রমাগত বাড়ছে করোনার মৃত্যু ও সংক্রমণে সংখ্যা। ৩০ শে জুন সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬৪ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। আগের দিন রেকর্ড সংখ্যক ৪ হাজার ১৪ জন শনাক্ত হন।

২৮শে জুন জারি করা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুসারে, বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হলে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য জন প্রতি ৫০০ টাকা এবং নির্ধারিত নমুনা সংগ্রহ বুথ বা সরকারি হাসপাতালে নমুনা দেয়া হলে ২০০ টাকা ফি দিতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য জন প্রতি তিন হাজার ৫০০ টাকা করে নিয়ে থাকে। যদি কারো নমুনা বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা হয় তবে এই ফি চার হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়।

পরিপত্রে আরো বলা হয়েছে, বিনামূল্যে হওয়ায় উপসর্গহীন অনেকেও পরীক্ষার জন্য নমুনা দিচ্ছেন। এতে আরো বলা হয়েছে যে পরীক্ষা থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। জানুয়ারির শেষ দিকে পরীক্ষা শুরু করে দেশে এখন পর্যন্ত সাত লাখ ৮৪ হাজার ৩৩৫টি নমুনা পরীক্ষা করেছে। দেশে বর্তমানে প্রতি ৫ জনে একজন করোনার রোগী শনাক্ত হচ্ছেন।

কোন দেশ কত ফি নিচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষার জন্য কোনো ফি নেয়া হয় না। তবে চিকিৎসার জন্য ৩০ হাজার ডলার বা তারও বেশি খরচ হতে পারে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস সন্দেহভাজন রোগীদের বিনাখরচে পরীক্ষা করছে। তবে বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করাতে ৩৭৫ পাউন্ড পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে।

ভারতে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে পরীক্ষা করা যায়। তবে কিছু বেসরকারি ল্যাব পরীক্ষার জন্য জনপ্রতি ৪ হাজার ৫০০ ভারতীয় রুপি ফি নিয়েছিল। পরে সরকারি নির্দেশনায় বেসরকারি ল্যাবে পরীক্ষার এই ফি কমানো হয়।

পাকিস্তাানে সরকারিভাবে সারা দেশে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হচ্ছে। তবে কিছু বেসরকারি ল্যাব নির্দিষ্ট ফি নিয়ে পরীক্ষা করছে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান সরকারও পরীক্ষার খরচ বহন করছে। যদি কেউ বেসরকারি পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা করে তাহলে তাদের একটি নির্দিষ্ট ফি দিতে হচ্ছে।

নেপালে সরকারিভাবে পরীক্ষার ব্যয় বহন করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশটি ঘোষণা করেছে যে বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিটি পরীক্ষার জন্য সরকার তাদের পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধ করবে।