লিনু হকের স্ট্যাটাস, কি ঘটেছিলো অর্থমন্ত্রীর পরিবারের লন্ডন ফ্লাইটে?

লিনু হকের স্ট্যাটাস, কি ঘটেছিলো অর্থমন্ত্রীর পরিবারের লন্ডন ফ্লাইটে?

লিনু হকের সাথে, আমার, আমাদের পরিচয় রাজপথেে। ৭০ এর দশকে আসীম সাহসী এই তরুণীকে মিছিলে, প্রতিবাদে রাজপথ চষে বেড়াতে দেখেছি।বুধবার বিকালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। লন্ডনে মেয়ের কাছে গিয়েছেন । বিমানে তাঁর অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন ফেসবুকে!

তাঁর পোস্ট পড়ে বিশ্বকবির কাছে আবারও অবনত হলাম ...।

পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

ক্ষমা চাই বৃটিশ বাংলাদেশী সেই নারী যাত্রীর কাছে!

“সবার দোয়া আর ভালোবাসায় ঠিকঠাক মত ইংল্যান্ড এসে পৌছেছি।

বিমান যাত্রায় এক বিরল দৃশ্য দেখার এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে এসেছি। না, সেলিব্রেটি হবার আকাঙ্ক্ষায় এ অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি না। সাম্প্রতি আমাদের বাংলা ভাষায় অনেক শব্দের সঙ্গে এ শব্দটির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আলহামদুলিল্লাহ বা আমিন শব্দে প্রবেশে যেমন অনেকের গাত্র দাহ দেখি। এ শব্দটি প্রবেশে তেমনটি দেখি না বরং যাদেরকে বলা হয় তারা সম্মানিত বোধ করেন।

আমার এ শব্দের প্রতি কোন আকাঙ্ক্ষা বা মোহ নেই।

তবে অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে দেশে ফিরে ডিজটালইল আইনে চৌদ্দ শিকের নিচে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। চৌদ্দ শিকে ঢোকার ব্যাপারে আমার প্রতি সৃষ্টিকর্তার এক সু-প্রসন্ন দৃষ্টি আছে। সৃষ্টকর্তার প্রতি আমার বিশ্বাস বরাবর রয়েছে। যখন বাম রাজনীতি করতাম তখনো মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাসে কোন দ্বন্দ্ব দেখিনি। কারণ তিনি মানুষকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। সু-প্রসন্ন এ জন্য বলছি কারণ জিয়া সরকার আমাকে চৌদ্দ শিকে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আমার অনেক সাথীদের ব্যপারে অবশ্য সফল হয়েছিলো।

এবার মূল বিষয় আসি, লন্ডন উদ্দেশ্য সময় মত বিমানে আরোহন করে বিমান ছাড়ার অপেক্ষা করছিলাম। বিমান ছাড়ার নির্ধারিত সময় হয়ে গেছে কিন্তু বিমান ছাড়ছে না। কারণ হিসাবে জানতে পারলাম বিমানের আট মুল্যবান যাত্রী বিমানে তখনো প্রবেশ করেনি। কিছুক্ষণ পরে কিচিরমিচির শব্দে বুঝতে পারলাম, যাক যাত্রীরা এসে পৌছেছে। কিন্ত হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি। আলোচনার আট জন যাত্রী বাংলাদেশের বিখ্যাত সম্মানজনক অর্থমন্ত্রীর পরিবারের।

বিমান বর্তমান সময়ের বাস্তবতায় নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে আসন বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্ত এই অভাগার ব্যপারে তা হয়নি। আমি এবং আমার সহযাত্রীকে পাশাপাশি বসতে হয়েছে। যদিও এ সাধারণ অধম মানুষটি, ধনী মানুষদের নির্ধারিত জায়গায় বিরাট মুল্য দিয়ে টিকেট সংগ্রহ করেছিলো সন্তানদের কৃপায়। তাঁরা সদ্য তাঁদের বাবাকে হারিয়েছে, তাই মাকে তাড়াতাড়ি হারাতে চায় না।

সম্মানিত মানুষের জন্য সামনের আসন বরাদ্দ। বিপাক বেঁধেছে একটি নির্ধারিত আসন নিয়ে। মন্ত্রীর সহধর্মিনী বলে কথা। সে-তো আর সাধারণ নয়। তার যেখানে ইচ্ছা সে সেখানে বসার অধিকার রাখে! কিন্ত তিনি যে আসনে বসতে চাচ্ছেন সে আসনটি দেয়া হয়েছে একজন বৃটিশ বাংলাদেশী মহিলাকে। যিনি কেভিডে শ্বশুরের মৃত্যুর কথা জেনে ছুটে গিয়েছিলেন, শ্বশুরের শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে। শ্বশুর তাঁকে তিন সপ্তাহ আগে ফোনে ডেকেছিলেন দেশে আসার জন্য। বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সে তখন আসতে পারেনি। মানুষ ভাবে এক আর সৃষ্ট কর্তা ভেবে রাখেন আরেক।

যাই হোক মহিলার জন্ম বেড়ে ওঠা বৃটেনে। বৃটেন শিক্ষা সংস্কৃতি নিয়ে বড় হওয়া মানুষ। সে-তো এ ধরনের ঘটনা কখনই অবলোকন করে নাই। সে বারবার বলছে, 'আমার নির্ধারিত আসন আমি কেন ছাড়বো?'

তাঁর যুক্তির কাছে মন্ত্রী অসহায়। ছোট স্বরে সে তার সহধর্মিণীর কাছে, মহিলার পক্ষে অনুরোধ রাখছে। একটা কথা আছে, সেনাবাহিনীতে অফিসার যদি কর্নেল হয় স্ত্রী হয় ব্রিগেডিয়ার মর্যাদার। কারন সেনাবাহিনীতে তাঁদের ভাষায় লেডী ওয়াইফ সব সময় সম্মানের। বিমান তো আর সেনাবাহিনী নয়। যুক্তি তর্ক মান,অপমান চলছে। এদিকে বিমানের যাত্রা বিলম্ব হচ্ছে। যতক্ষণ না এ সমস্যার সমাধান হবে ততক্ষণ বিমান আকাশে উড়াল দিতে পারছে না।

এই সমস্যার কথা কেবিন ক্রু যখন উচ্চারণ করলো, সাথে সাথে বৃটিশ বাংলাদেশী নাগরিক আসন ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার শিক্ষ মানুষকে সম্মান দিতে শিখিয়েছে। আমি আমার সাথে জড়িত ৩৫০ জন যাত্রীকে আমি কষ্ট দিতে পারি না। তাই আমি আসন ছেড়ে পেছনের আসনে চলে যাচ্ছি, কিন্তু ধিক্কার জানিয়ে যাচ্ছি আমার পূর্ব পুরুষদের দেশের নাগরিকদের।

আমরা যারা এ দেশটির জন্মের পেছনে ভূমিকা রেখেছিলাম তাঁরা ভদ্রমহিলার কাছে ক্ষমা চাইলাম বারবার। বললাম, 'ক্ষমা করে দেন, আমরা দেশ দিয়েছি মানুষ দিতে পারিনি।'

উল্লেখ করার মত দুটো কথা না উল্লেখ করলেই নয়। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কথা (না চৌদ্দ শিক থেকে মুক্তি পাবার ভয়ে নয়)। কেবিন ক্রুরা বারবার বলছিলেন, যাত্রী হিসাবে তাঁর অমায়িক ব্যবহারের কথা। একজন বলছিলেন ৭৫ বঙ্গবন্ধু যখন মৃত্যুবরণ করেন সে তখন খুব ছোট, তাঁর মা নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছিলেন। মা'কে কান্নার কারণ জানতে চাইলে মা তাঁকে বঙ্গবন্ধুর কথা বলেছিলেন। পরে তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কে যখন যাত্রী হিসাবে দেখেন তখন অনুধাবন করেন কেন তাঁর মা কেঁদেছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা আমাকে নিয়ে, হঠাৎ দেখি কেবিন ক্রু'রা আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! এ সামান্য ব্যক্তিকে না খুঁজে পাবারই কথা!

সামান্য আজকে অসামান্য হয়ে উঠেছে,শহীদ বুদ্ধিজীবি আনোয়ার পাশার সন্তানের কারণ। তিনি বিমানের একজন পদস্ত কর্মকর্তা। কেবিন ক্রুদের বলে দিয়েছেন, 'আমার আপা আপনাদের বিমানে ভ্রমণ করছেন।'

না তাঁর সাথে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। আমি তাঁকে বলিও নি আমি বিমানে ভ্রমন করছি। আরেক বুদ্ধিজীবির সন্তান, তাঁরা পরস্পর আত্মার আত্মীয়, তিনি তাঁকে বলেছিলো, আমার আপা এই বিমানে চড়ে লন্ডন যাত্রা করছেন। অনেকে বলে থাকেন, আমি কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধ, আর তাঁর মুল্যবোধ টেনে আনি। যে কথাটি নাকি বস্তা পঁচা হয়ে গেছে।

আমার অস্তিত্বে মুক্তিযুদ্ধ, আমি তাঁকে জীবন থেকে বাদ দেই কি করে?

স্যালুট আনোয়ার পাশার সন্তানকে (যাকে এখন পর্যন্ত চোখে দেখিনি) পেছনের আসনের একজন সাধারণ যাত্রীকে অসাধারণ সম্মান জানাবার জন্য।

আমরা বেঁচে আছি পরস্পরের হাত ধরে! “

(ফেসবুক থেকে)

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার সচিব