রিজেন্ট হাসপাতাল কোভিড ডেডিকেটেড হয় কার ইশারায়?

রিজেন্ট হাসপাতাল কোভিড ডেডিকেটেড হয় কার ইশারায়?

কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয় গত ২১ মার্চ। অথচ হাসপাতালটির অনুমোদনের মেয়াদ ২০১৪ সালেই শেষ হয় এবং পরে আর সেটা নবায়ন করা হয়নি। অনুমোদনহীন একটা হাসপাতাল মহামারির মতো সময়ে কী করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার তালিকাতে যুক্ত হলো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে ‍‘উপরের কেউ’ বলার কারণে রিজেন্টকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, রিজেন্ট হাসপাতাল করোনা পরীক্ষার ভুয়া সনদ দিতো বলে প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাব। উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে আট জনকে আটক করে র‌্যাবের মোবাইল কোর্ট। সোমবার (৬ জুলাই) র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে হাসপাতালটিতে অভিযান চালায় র‌্যাব। হাসপাতালটি টেস্ট না করেই কোভিড-১৯ ‘পজিটিভ’ ও ‘নেগেটিভ’ সনদ দিতো বলে জানিয়েছেন সারওয়ার আলম।

সারওয়ার আলম সাংবাদিকদের জানান, তিন ধরনের অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ পেয়েছেন তারা। নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট দিতো তারা, সরকার নির্ধারিত হওয়াতে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার কথা তাদের, কিন্তু তারা রোগীপ্রতি লক্ষাধিক টাকা নিয়েছে পাশাপাশি রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে মর্মে সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দিয়েছে।

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতাল এ পর্যন্ত শ’ দুয়েক কোভিড রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তৃতীয় অপরাধ হলো, সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের তারা কোভিড পরীক্ষা করবে বিনামূল্যে। কিন্তু তারা আইইডিসিআর, আইটিএইচ ও নিপসম থেকে ৪ হাজার ২০০ রোগীর বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে এনেছে।’

তিনি বলেন, ‘২০১৪ সালে হাসপাতালটির অনুমোদনের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবুও তারা স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে কীভাবে সনদ নিয়েছে বোধগম্য নয়। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ৭ জুলাই রিজেন্টের মূল কার্যালয় এবং হাসপাতালে সিলগালা করে র‌্যাব। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে দেওয়া এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, অনিয়মের কারণে এবং দ্য মেডিক্যাল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ রেগুলেশন অর্ডিন্যান্স-১৯৮২ অনুযায়ী হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অথচ এ হাসপাতালটিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রিজেন্ট হাসপাতাল রোগীদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে বিরাট অঙ্কের টাকা আদায় করছে। অনুমোদন না থাকার পরেও আরটি-পিসিআর পরীক্ষার নামে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, তাগিদ দেওয়ার পরেও লাইসেন্স নবায়ন না করাসহ আরও অনিয়ম করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের অবহেলা দুটোই ছিল। মোটা দাগে, এটি আইন ও নিয়মনীতির যে দৃষ্টান্ত, বিশেষ করে বিচারহীনতার সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত। ২০১৪ সাল থেকে লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি এমন প্রতিষ্ঠান কোভিড চিকিৎসা দূরে থাক, এতদিন পর্যন্ত চিকিৎসাসেবা কী করে দিতে পারলো–সেটাই বড় প্রশ্ন।’

এখানে আইনের প্রয়োগের ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘কেবল তাই নয়, আইন অমান্য করেও যে ফ্লারিসিং বিজনেস চালানো যায় এটি তার উদাহরণ। আর এরকম একটা প্রকট অবস্থার মধ্যে চলে যাওয়ার পর বিষয়টি চিহ্নিত হলো। কিন্তু দেখার বিষয়, যাদের আটক করা হচ্ছে তারাই যে এর জন্য দায়ী তা নয়। এর সঙ্গে যোগসাজশ করেছে ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা কাছাকাছি মহল। তাদের কতখানি জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাবে তার ওপরই নির্ভর করবে বাস্তবে এ ধরনের সংস্কৃতি চলতেই থাকবে নাকি তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।’

হাসপাতাল মালিকের ক্ষমতা এবং স্বাস্থ্য অধিদফতরের অবহেলা দুটোই রয়েছে মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রিজেন্ট মালিক মো. সাহেদ নিজেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং বিভিন্ন প্রভাবশালী মানুষের পরিচয় দিয়ে চলাফেরা করেন। অধিফতরের অযোগ্যতা হচ্ছে এ হাসপাতালটিকে কোভিড ডেডিকেটেড হিসেবে নির্ধারণ করা।’

‘যেখানে জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন, সেখানে কোয়ালিটি ও আইনগত অবস্থানের বিষয়ে ক্লিয়ার থাকা দরকার ছিল। অথচ স্বাস্থ্য অধিদফতর একটি বেআইনি প্রতিষ্ঠানকে নিজেরাই নির্ধারণ করেছে। বৈধতা নেই এমন হাসপাতালকে সরকারিভাবেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অথচ এটা তাদের (স্বাস্থ্য অধিদফতর) দেখা দরকার ছিল। স্বাস্থ্য অধিদফতরের অযোগ্যতার জন্য সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত।’ বলেন অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান।

‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গে মিটিং’ লিখে সাহেদের ফেসবুক পোস্ট অনুমোদনহীন একটা হাসপাতালকে কী করে অধিদফতর কোভিড চিকিৎসায় নির্ধারণ করে দিলো জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘আপনি এপ্রিল মাসের কথা চিন্তা করুন। তখন রোগীরা ঘুরে বেড়াচ্ছিল, বেসরকারি কোনও হাসপাতাল রোগী নিচ্ছিল না। সেই সময় আমাদের কেউ বলেছে, তারা (রিজেন্ট হাসপাতাল) এরকম (রোগী ভর্তি) করতে চায়, আপনারা দেখেন। তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে রোগীর সেবার জন্য। তখন এটা বিবেচনা করা হয়নি, দেখা হয়নি।’

সেই ‘কেউ’টা কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বলেছেন “উপরের কেউ”, কিন্তু আমি তো আর এই মুহূর্তে বলতে পারবো না। আর আমরা তো তাকে চিনি না।’ বলেন ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা। অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল) তাকে চেনেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, পরিচালক তাকে কেমন করে চিনবে।’

তাহলে কীসের ভিত্তিতে, কোনও যাচাই-বাছাই ছাড়া রিজেন্টকে অধিদফতর থেকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল নির্ধারণ করা হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা পরিচালককে (হাসপাতাল) জিজ্ঞেস করুন।’

তবে কিছু সময় পর এ প্রতিবেদককে এই কর্মকর্তা ফোন করে বলেন, ‘কিছু তথ্য আমি সঠিক দিইনি। সেটা হলো, পরিচালক (হাসপাতাল) জানতো যে নবায়ন হয়নি। তাকে শর্তই দেওয়া হয়েছিল, সে লাইসেন্স নবায়ন করবে।’ সেটা মনিটর করা হচ্ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের তাগিদ দেওয়া হচ্ছিল।’

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বিএমএ’র (বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘২০১৪ সালের পর যে হাসপাতালের নবায়ন করা হয়নি, যে হাসপাতালে এত অনিয়ম সে হাসপাতালকে কোন বৈধতায় স্বাস্থ্য অধিদফতর কোভিডের মতো মহামারিতে সরকারি তালিকাভুক্ত করলো, সেটা খুঁজে বের করা দরকার। তারা তো কিছু চেকই করেনি, যদি করতো তাহলে ধরা পড়তো। পরবর্তী সময়েও হাসপাতালটিকে মনিটর করা হয়েছে কিনা প্রশ্ন করে অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বা পরিচালক ( হাসপাতাল) এসব ইন্সপেকশন করে না, তারা তাদের রুটিন কাজও করেনি। এতে তাদের অবহেলা এবং অদক্ষতা দুটোই রয়েছে।’

এসব বিষয়ে কথা বলতে গণমাধ্যম থেকে একাধিকবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আমিনুল হাসানকে মোবাইল ফোনে কল করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি, তিনি উত্তর দেননি।

সব জেনেও চুপ ছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমের কাছে ‘আমরা তো তাকে চিনি না’ বলেছিলেন। অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সেই কর্মকর্তাদের সঙ্গেই রিজেন্ট চেয়ারম্যান মো. সাহেদের ছবি ছড়িয়ে পড়ে।

এদিকে গত ৭ জুন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেনশন অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের ( নিপসম) পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ রিজেন্টের প্রতারণা নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর বরাবর চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি বলেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতাল নমুনা দেওয়ার নাম করে সাড়ে তিন হাজার টাকা আদায় করছে। অথচ নিপসম তথা সরকার বিনামূল্যে আরটি পিসিআর পরীক্ষা করছে।’ বিষয়টি সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, ‘কীভাবে স্যাম্পল সরবরাহ করতে হবে সে বিষয়েও নির্দেশিকা রিজেন্ট হাসপাতালকে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া বা সতর্ক করার পরও রিজেন্ট হাসপাতাল তা অনুসরণ করছে না। যার কারণে রিজেন্ট হাসপাতালের কোনও স্যাম্পল নিপসমের পক্ষে পরীক্ষা করা যুক্তিযুক্ত নয় বলে প্রতীয়মান হয়।’ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরকে।

তার ঠিক দুই দিন পর (৯ জুন) নিপসম পরিচালককে ফিরতি চিঠি দিয়ে প্রতিদিন উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতিদিন ৫০টি নমুনা পরীক্ষার জন্য ‘নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো’ বলে জানানো হয়। সুত্র: বাংলাট্রিবিউন।