জালিয়াতি করে মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি হওয়া ৪০০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কোন পথে?

জালিয়াতি করে মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি হওয়া ৪০০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কোন পথে? ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হন, এদের মধ্যে ৭৮ জন শিক্ষার্থীর নামের তালিকা সিআইডিকে দিয়েছেন রিমান্ডে থাকা তিন আসামি।

ফাঁস হওয়া প্রশ্নে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছে অন্তত ৪০০০ শিক্ষার্থী। এদেরমধ্যে অনেকেরই এখন পড়াশুনা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ তারা ডাক্তার হওয়ার পথে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ বলছে, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দু’জনের আত্মীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরে চাকরি করতেন। তাদের মাধ্যমেই স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকে প্রশ্নপত্রগুলো বাইরে চলে আসত এবং লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হতো। একেকজনের কাছ থেকে ১০ লাখ বা তার চেয়েও বেশি টাকা নিয়ে প্রশ্ন দেওয়া হতো। এভাবেই প্রশ্ন ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জালিয়াতচক্রের সদস্যরা। কিন্তু এই জালিয়াতচক্রের শেকড় কী যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের পর্যন্তই নাকি আরো অনেক গভীরে বিস্তৃত -সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা।

সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে ইতিমধ্যে প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের আশ্রয়–প্রশ্রয়দাতা, সহযোগিতাকারী এবং জালিয়াতি করে যারা মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন তাদের সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকে প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের যেসব সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে দুজনের আত্মীয় অধিদফতরেই চাকরি করতেন। এরমধ্যে অধিদফতরের প্রেসের মেশিনম্যান সালামের নাম এসেছে। বলা হচ্ছে, তিনি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের প্রশ্নপত্র ছাপানোর সময় বিশেষ কৌশলে তা বের করে এনে তুলে দিতেন আত্মীয় জসিমের হাতে। কিন্তু এমন স্পর্শকাতর এলাকা থেকে এই কাজ শুধুমাত্র একজন মেশিনম্যানের মাধ্যমে সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন এসেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই চক্রের সঙ্গে খোদ অধিদফতরেরই অনেক রাঘববোয়াল জড়িত রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকও কিছু জানেন না বলে এই দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সিআইডি ইতিমধ্যে জানিয়েছে, এই জালিয়াতচক্রের সঙ্গে অন্তত ২০০ জনের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে তারা। এই ২০০ জনের সবই যে বাইরের লোক তা ভাবার অবকাশ নেই। কারণ, বছরের পর বছর এহেন স্পর্শকাতর জালিয়াতি শুধুমাত্র একজনের পক্ষে সম্ভব নয়। কর্মরতদের মধ্যে বড় এবং প্রভাবশালী সিন্ডিকেটই এই প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। মাঠ পর্যায়ের চুনোপুঁটি জালিয়াতরা গ্রেফতার হলেও সিন্ডিকেটের রাঘববোয়ালরা কী ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন সেই প্রশ্নও সামনে এসেছে। সামনে এসেছে, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এই নাজুক এবং আস্থাহীন ভঙ্গুর দশার মধ্যেই যদি ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়া এই মেধাহীন, জোচ্চোর আর প্রতারক চার হাজার ডাক্তার এবং ডেন্টিস্ট আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুক্ত হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী হবে?

বিগত সময়ে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া ছাত্রছাত্রীরা প্রশ্নফাঁস হয়েছে দাবি করে আবার পরীক্ষার দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলো। আর খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজি তখন পরীক্ষা স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে পুনরায় পরীক্ষা নেয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সেই প্রত্যাখ্যান কাদের স্বার্থে ছিলো বিশ্লেষকরা সেই প্রশ্ন তুলেছেন ? ফাঁস হওয়া প্রশ্ন নিয়ে যে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে সেই টাকা কোথায় কোথায় বিলি বন্টন হয়েছে সেই প্রশ্নও তুলেছেন তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, আবার পরীক্ষা নিলে এই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো না, বারবার এর পুনরাবৃত্তি হতে পারতো না। হয়তো কয়েকজনের আত্মীয়, বন্ধুকে সুযোগ করে দিতে কিংবা অবৈধ লেনদেনের জন্য সেই পরীক্ষাগুলোকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছিলো। যারা করেছিলো তাদের বিচার হবে কি? এক-দুজন নয়, ৪০০০ ছাত্র-ছাত্রী প্রশ্ন কিনেছিলো। এতো বিশাল সংখ্যা? তারা পড়াশুনা শেষ করেও আদৌ কতটা চিকিৎসক হবে সেটি আরো উদ্বেগের বিষয়। তারা একেকজন ৭-৮ লাখ টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনেছে। টাকাগুলো নিশ্চয়ই তাদের বাবা-মায়েরা দিয়েছিলো। এরা ছেলেমেয়েদের যে শুরুতেই অসৎ হতে উৎসাহ দিলো, এসব ছেলেমেয়েরা ডাক্তার হয়ে কি সততার সাথে চিকিৎসা সেবা দেবে? নাকি ডায়াগনস্টিক টেস্টের কমিশন, ওষুধ কোম্পানির দালালি আর হাসপাতাল বাণিজ্য করে স্বাস্থ্যখাতের লালবাতি জ্বালাবে? আর সেই সাথে সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলবে -এমন প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।

তারা বলছেন, যে ৪০০০ ছাত্রছাত্রী শৈশব থেকে ডাক্তার হবার স্বপ্ন নিয়ে পরিশ্রম আর পড়া-লেখা করে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো, তাদের ক্যারিয়ার ধ্বংস আর স্বপ্নভঙ্গের মূল্য কতো? জাতি যে মেধাবী ৪০০০ ডাক্তার পেলো না, এই ক্ষতির মূল্য কতো? এই অপূরণীয় ক্ষতির দায়দায়িত্ব কাদের? তাদের সেই স্বপ্ন ও ক্যারিয়ার জীবন কি ফিরিয়ে দেয়া যাবে?

সিআইডি বলছে, যেসব শিক্ষার্থী ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছে ইতিমধ্যে তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়েছে। তবে এই ৪০০০ জালিয়াত শিক্ষার্থীকে মেডিকেল আর ডেন্টাল হতে বহিষ্কার করা এবং ফৌজদারি আইন অনুযায়ী শাস্তি দেয়ারও দাবি উঠেছে। এই অপকর্মে সহায়তার অপরাধে তাদের অভিভাবকদেরও যথাযথ শাস্তির আওতায় আনার দাবি উঠেছে।

বিশ্লেষকরা উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, প্রশ্নফাঁসের ফলে একটি নীতিহীন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের বেড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয়েছে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবার মধ্যেই একটি ব্যাধি সংক্রামক আকারে বাড়ছে। এটা রোধ করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে একটি নীতিবিবর্জিত প্রজন্ম উপহার দেয়ার মতো বিপর্যয় নেমে আসতে পারে গোটা জাতির উপর।