দেশি-বিদেশি কোম্পানির নামে ডোমেইন কিনে প্রতারণা

দেশি-বিদেশি কোম্পানির নামে ডোমেইন কিনে প্রতারণা

দেশি-বিদেশি খ্যাতনামা কোম্পানির নামে ডোমেইন কিনে প্রতারণা চালাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। ব্ল্যাকমেইল করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্রটি।

দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কার্যকলাপ চালালেও সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। এক্ষেত্রে অসহায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি)।

এরকম অসংখ্য অভিযোগ বিটিআরসিতে ফাইলবন্দি হয়ে আছে বলে জানা গেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘অ্যামাজন’ বাংলাদেশে কোনো প্রকার কার্যক্রম শুরু না করলেও একটি চক্র প্রতিষ্ঠানটির নামে প্রতারণা করে যাচ্ছে।

ইতোমধ্যে চক্রটির কেউ কেউ রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজে (আরজেসি) ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ’ নামটি তালিকাভুক্ত করেছেন।

বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ব্যবসা করতে চাইলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেয়ার নিয়ম থাকলেও এই দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশে অ্যামাজনের কার্যক্রম সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।

বিশেষজ্ঞরা জানান, কোনো ধরনের সরকারি অনুমোদন ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ই-কমার্স কোম্পানি অ্যামাজনের নামে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু হলে বড় ধরনের প্রতারণা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্ডার দেয়া পণ্য না পাওয়া এবং অনলাইনে পেমেন্টের টাকা বেহাত হতে পারে বলে খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

অতীতে বেশ কয়েকটি দেশে অ্যামাজনের নাম ব্যবহার করে এমন প্রতারণার নানান অভিযোগ অনলাইন ফোরাম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা গেছে।

জানা যায়, আমান উল্লাহ চৌধুরী নামে এক ব্যক্তি জয়েন্ট স্টক থেকে ‘অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামটি তালিকাভুক্ত করেছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় তিনি নিজেকে অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন।

অ্যামাজন-বিডি (amazon-bd.com) নামে একটি ডোমেইনও কিনেছেন তিনি। সেই ডোমেইন অ্যামাজনের মূল সাইটের সঙ্গে রিডিরেক্ট (ক্লিক করলে মূল সাইটে চলে যাবে) করে রেখেছেন।

অ্যামাজনের পলিসি অনুযায়ী তাদের ডোমেইনের মালিকানা লেখা থাকে অ্যামাজন টেকনোলজিসের নামে। আর অ্যামাজন-বিডির ডোমেইনের মালিকানা দেখাচ্ছে অ্যামাজন বাংলাদেশ লিমিটেডের নামে।

এদিকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ই-কমার্স সাইট বাংলাদেশে চালুর বিষয়টি সরকারের কোনো মহলই জানে না। এমনকি যিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দাবি করছেন তাকেও খাত সংশ্লিষ্টরা কেউই চিনছেন না।

বাংলাদেশে ই-কমার্স ব্যবসায়ীদের সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর অর্থ সম্পাদক আবদুল হক অনু বলেন, বাংলাদেশে অ্যামাজন আসার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো খবর নেই। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নজর দেয়া উচিত।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এই খাতের সব খবর রাখলেও অ্যামাজন বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি জানান, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই। এছাড়া আমাদের কাছে আবেদন করারও কিছু নেই। এ বিষয়ে জানলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিডা জানতে পারে।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু বিষয়ে কাজ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) সেল। ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা এখনও বাংলাদেশে ব্যবসা করার জন্য অ্যামাজন থেকে কোনো ধরনের আবেদন পাইনি। স্থানীয়ভাবেও কেউ আবেদন করেনি। তবে দুই মাস আগে বাংলাদেশের পণ্য বিদেশে বিক্রি করার বিষয়ে আলাপ করতে ভারত থেকে একটি প্রতিনিধি দল এসেছিল। তবে তারা এ দেশে পণ্য বিক্রি করার বিষয়ে কোনো আলাপ করেনি।’

বিদেশি যে কোনো বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমতি নিতে হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘যদি কেউ এ ধরনের কার্যক্রম চালিয়ে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

বাংলাদেশে ই-কমার্স খাতে বিনিয়োগের বিষয়টি দেখেন বিডার পরিচালক মো. আরিফুল হক। তিনি জানান, ই-কমার্সে ব্যবসা করার জন্য আলিবাবা, দারাজ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করলেও অ্যামাজন আমাদের সঙ্গে কোনোরকম আবেদন বা বিনিয়োগ করেনি। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্যও নেই।’

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একটি বিদেশি কোম্পানির নাম বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন করে রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতে ওই কোম্পানি বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করতে হলে তাদেরকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নামের হস্তান্তর করতে হবে। আমরা আগেও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ভাঙিয়ে এভাবে প্রতারণা করতে দেখেছি। আমরা নিজেরাও এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়ে সমাধান করেছি।’

বেসিসের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে একটি চক্র আছে যারা এই প্রতারণাকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছে। চক্রটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির নামে বাংলাদেশে ডোমেইন কিনে রেখেছে।

এরপর গুগলে সেগুলো লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে বলে অফার দিয়ে রেখেছে। জানা গেছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো যখন বাংলাদেশে তাদের কোম্পানির নামে ডোমেইন কিনতে যাচ্ছে তখনই দেখা যাচ্ছে সেটি নেই।

তখন বাধ্য হয়ে ওই কোম্পানিকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ওই সিন্ডিকেটের কাছ থেকে ডোমেইন কিনে নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্বসেরা অ্যামাজনের নাম ব্যবহার করে যে কেউ শত শত কোটি কোটি টাকার অর্ডার নিয়ে পালিয়ে যেতে পারেন।

কাজেই সরকার বা সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত এখনই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া। অন্যথায় লাখ লাখ মানুষ প্রতারণার শিকার হতে পারেন।

অ্যামাজন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবিদার আমান উল্লাহ চৌধুরী নিজে স্বীকার করেছেন যে বাংলাদেশে তাদেরকে কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়নি বিদেশি কোম্পানি অ্যামাজান।

তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে তাদের পুরোপুরি আনুষ্ঠানিকতা হয়নি। কোভিডের কারণে অ্যামাজনের লোকজন বাংলাদেশে আসতে পারেনি। তারা সার্ভে করে গেছে। সবকিছু কমপ্লিট। বাংলাদেশের অপারেশন যেহেতু আমরা দেখব তাই তারা অ্যাপ ইস্যুসহ কিছু ফিল্ড ওয়ার্ক দিয়েছে; সেগুলোর কাজ আমরা করছি।’

অ্যামাজন থেকে এখানে কাউকে নিয়োগ দেয়া না হলেও বাংলাদেশে অ্যামাজনের অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করছে এমন ১৮ সদস্যের একটি টিম তাদের রয়েছে বলে দাবি করেন আমান উল্লাহ।

তিনি বলেন, সরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশে অ্যামাজন আসার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলেই রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ তাদের অনুমোদন দিয়েছে।

এমজে/