মসজিদে বিস্ফোরণের দায় চাপাচ্ছে একজন আরেকজনের কাঁধে

মসজিদে বিস্ফোরণের দায় চাপাচ্ছে একজন আরেকজনের কাঁধে

নারায়ণগঞ্জের তল্লায় বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের দায় একজন আরেকজনের কাঁধে চাপাচ্ছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও তিতাসের দায়ের করা তদন্ত প্রতিবেদন পরস্পরবিরোধী বলে মনে করেছে এলাকাবাসী। অন্য দিকে ঘটনায় দায় কেউই নিতে চাচ্ছে না। তিতাস দায়ী করছেন মসজিদ কমিটিকে। অন্য দিকে মসজিদ কমিটি বলছে তিতাসের রিপোর্ট বানোয়াট। এ ছাড়া জেলা প্রশাসনের তদন্ত রিপোর্টে গ্যাসের পাইপলাইনের লিকেজ, মসজিদে থাকা বিদ্যুৎ সংযোগের স্পার্ক ও যৌথভাবে তিতাস ও মসজিদ কমিটির অবহেলাজনিত কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পরস্পরবিরোধী রিপোর্টের কারণে ৩১টি তাজা প্রাণ পুড়ে মরে যাওয়ার জন্য যারা দায়ী, তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন এলাকাবাসী। গতকাল জুমা নামাজের পর মসজিদ কমিটির সভাপতি আবদুল গফুর তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলে, তিতাস কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায় এড়ানোর জন্য মসজিদ কমিটির ওপর দোষ চাপিয়েছেন। তিতাস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এমন প্রতিবেদনে আমরা হতাশ।

এ দিকে বিস্ফোরণে নিহত মসজিদের ইমাম মাওলানা আবদুল মালেক নেসারীর ছেলে নাইমুল ইসলাম জানান, তিতাস নিহতদের পরিবারের প্রতি যাতে ক্ষতিপূরণ দিতে না হয়, এ জন্য তারা পাঁয়তারা করছে। তিনি বলেন, পরিকল্পিতভাবে তিতাস দায় এড়ানোর জন্য মসজিদ কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছেন। এ তদন্ত প্রতিবেদন আবার পর্যবেক্ষণ করে, আবার দিতে হবে। তিতাস তার দায় এড়ানোর চেষ্টা করলে নিহতদের পরিবার প্রয়োজনে আন্দোলনে যাবে। তিতাসের তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নিহত অন্যান্য পরিবারও। তাদের অভিযোগ তিতাসের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনটি সঠিক নয়।

অন্য দিকে এলাকাবাসীর দাবি, প্রতিবেদনটি আবার তদন্ত করা হোক। মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন বৃহস্পতিবার জমা দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। প্রতিবেদনে গ্যাসের পাইপলাইনের লিকেজ, মসজিদে থাকা বিদ্যুৎ সংযোগের স্পার্ক ও যৌথভাবে তিতাস ও মসজিদ কমিটির অবহেলাজনিত কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

বিস্ফোরণের ১৪ দিন পর গত বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিনের হাতে ওই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খাদিজা তাহেরা ববি।

জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ১০ কার্য দিবসে তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, মসজিদ কমিটিসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাথে কথা বলে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে জমা দিয়েছেন। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও তাদের দেয়া সুপারিশ বিবেচনা করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তিনি আরো বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। এতে তিতাস গ্যাসের লিকেজ থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে মসজিদের ভেতরে জমা হয় এবং বিদ্যুতের স্পার্ক থেকে আগুন ও বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়। এ ছাড়া মসজিদ কমিটির গাফিলতি ছিল তা তদন্তে উঠে এসেছে।

কী কারণে বিস্ফোরণ? জবাবে এএসপি টি এম মোশারফ হোসেন বলেন, এখানে গ্যাসের লিকেজ পাওয়া গেছে। আগে থেকে গ্যাস জমে থাকায় বিদ্যুতের শটসার্কিট থেকেই দুর্ঘটনা ঘটার অন্যতম কারণ। আর তিতাস ও মসজিদ কমিটির অবহেলাজনিত কালবিলম্ব এটাও আমরা কারণের মধ্যে এনেছি। এ ছাড়াও ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের কোনো ঘটনা না ঘটে সে জন্য ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে।

কাউকে গ্রেফতার করার জন্য সুপারিশ করেছেন? জবাবে তিনি বলেন, না। আমরা ঘটনা কিভাবে ঘটেছে, এটার প্রাতিষ্ঠানিক কী কী দুর্বলতা ছিল এবং আমার কিছু সুপারিশ করেছি, যাতে এগুলো প্রতিফলন করা হয় ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। তদন্তে বিস্ফোরণের জন্য এককভাবে কাউকে দায়ী করা হয়নি।

বৃহস্পতিবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে তিতাসের তদন্ত কমিটির প্রধান প্রকৌশলী আবদুল ওয়াহাব তালুকদার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ খান বিপুর কাছে এ তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

১৬ পাতার একটি তদন্ত প্রতিবেদনে তিতাস উল্লেখ করে, মসজিদ কমিটি দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কয়েক দিন আগে থেকেই মসজিদে গ্যাসের গন্ধ পাচ্ছিলেন। তার পরও মসজিদ কমিটি এসি অংশের দরজা জানালা বন্ধ করে এসি চালিয়ে নামাজ আদায় করছেন। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য মুসল্লিদের কোনো রকম সতর্ক করা হয়নি। মসজিদ কমিটির অজ্ঞতা-অসচেতনতার জন্য এবং মসজিদে অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য এহেন দুর্ঘটনার সৃষ্টি হতে পারে। তাই এর দায়ভার তাদের ওপর বর্তায়।

মসজিদ কমিটি আলোচ্য দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন মিডিয়াতে গ্যাস লিকেজ মেরামতের জন্য তিতাস গ্যাসের লোকজন তাদের কাছে ৫০ হাজার টাকা চেয়েছে মর্মে মসজিদ কমিটির সভাপতি একটি অভিযোগ এনেছিলেন। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি, মসজিদ কমিটির সভাপতি ও জমির দাতার কাছে বিষয়টি বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা দু’জনই তাদের লিখিত জবাবে এ বিষয়ে কিছুই জানেন না মর্মে উল্লেখ করেন।

তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ১৯৮৭ সালে মসজিদসংলগ্ন এলাকায় ১ ইঞ্চি ব্যাসের একটি ৫০ পিএসআইজি চাপের একটি বিতরণ লাইন নির্মাণ করে তিতাস। ওই লাইন থেকে ১৯৯৬ সালের ১৮ এপ্রিল মসজিদের উত্তর পাশে শওকত আলী ও বারেক দেওয়ানকে আবাসিক সংযোগ দেয়া হয়।

কমিটি আরো জানায়, মসজিদটি নির্মাণ ও তিনতলাবিশিষ্ট মসজিদ ভবন নির্মাণ করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন থেকে অনুমোদন নেয়া হয়নি, যা মসজিদ কমিটির তাদের বক্তব্যে উল্লেখ করেছে।

গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে ১৯৯৮ সালে মসজিদের উত্তর পাশে আরেকটি ৩ ইঞ্চি ব্যাসের বিতরণ লাইন বসায় তিতাস। এরপর উল্লিখিত গ্রাহকরা তিতাসের নীতিমালা ও অনুমোদন ছাড়াই অবৈধপন্থায় ওয়েল্ডার দিয়ে ১ ইঞ্চি থেকে ৩ ইঞ্চি লাইনে শিফট করেন। কিন্তু নিয়মানুযায়ী শিফটিং করলে তিতাস কর্তৃপক্ষ আগের ১ ইঞ্চি লাইন ২টি মূল বিতরণ লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিত। ফলে ওই ২টি লাইন তখন থেকেই পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।

পাকা মসজিদ নির্মাণ করার সময় কংক্রিটের ঢালাইয়ের জন্য সাটারিং এবং বেইজ নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত কোদাল, হাতুড়িসহ নানা যন্ত্রের আঘাতে ওই পরিত্যক্ত সার্ভিস লাইনের রেপিং নষ্ট হয়। ফলে মাটির সংস্পর্শে এসে মরিচাজনিত কারণে পাইপের নানা স্থানে ছিদ্র বা লিকেজ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে লিকেজের মাধ্যমে গ্যাস মসজিদের নিচে আড়াআড়িভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেটি মসজিদের ফ্লোর টাইলসের সংযোগ ও মসজিদের কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে নির্গত হতে থাকে।

মসজিদের টাইলসের নিচে বিদ্যমান বালু মাটি যথাযথ ছিল না এবং মাটির নিচে মসজিদের ওয়াল নির্মাণের গুণগতমান কারিগরিভাবে যথোপযুক্ত ছিল না। মসজিদের নিচের বালুর কমপেকশন এবং দেয়াল নির্মাণ সঠিক থাকলে পাইপলাইন হতে নিঃসরিত গ্যাস মসজিদের নিচে যেতে পারত না। ফলে মসজিদের টাইলসের ভেতর থেকে বা মেইন গেটের কলাপসিবল গেটের নিচ হতে গ্যাস বের হতে পারত না। ফলে এহেন দুর্ঘটনার সুযোগ সৃষ্টি হতো না।

৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। একজন বাড়ি ফিরলেও চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরো চারজন

এমজে/