দেশে বিনিয়োগ কমেছে ১৯%

দেশে বিনিয়োগ কমেছে ১৯%

কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় বিশ্ব অর্থনীতি দীর্ঘ মন্দার কবলে পড়েছে। দেশে দেশে চাহিদা পড়ে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এই পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই কমে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থার (আঙ্কটাড) প্রাক্কলন অনুযায়ী, বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথমার্ধে এফডিআই ১৯ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১১৬ কোটি ৪৩ লাখ ডলার, ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে যা ছিল ১৪৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক বছরের প্রথম প্রান্তিকের (জানুয়ারি-মার্চ) বিদেশি বিনিয়োগের যে পূর্ণাঙ্গ উপাত্ত প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে ৫৮ কোটি ২১ লাখ ডলার—গত বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় প্রায় ৪৮ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে দেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১০৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলার। যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংকের উপাত্তই আঙ্কটাড প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহার করে, সেহেতু প্রথম প্রান্তিকের বা তিন মাসের নিট বিদেশি বিনিয়োগকে ছয় মাসে দ্বিগুণ ধরে নিয়ে জাতিসংঘের সংস্থাটি এই প্রাক্কলন করেছে।

বছরের প্রথমার্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় এফডিআই কমেছে ৩১ শতাংশ বা ২ হাজার কোটি ডলার।

বিশ্বজুড়ে এফডিআই হ্রাস

করোনার ধাক্কায় বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) যে কমে যাবে, সেটা এ বছরের প্রথমভাগেই ধারণা করা হয়েছিল। আঙ্কটাড গত মঙ্গলবার ইনভেস্টমেন্ট ট্রেন্ডস মনিটরের যে হালনাগাদ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বৈশ্বিক বিদেশি বিনিয়োগ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৯ শতাংশ কমেছে।

২০১৯ সালের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক বিদেশি বিনিয়োগ (গড়ে) ছিল ৭৭ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। আর আঙ্কটাডের প্রাক্কলন, চলতি বছরের প্রথমার্ধে এটি নেমে এসেছে ৩৯ হাজার ৯০০ কোটি ডলারে।

এর আগে জুন মাসে আঙ্কটাড যখন বৈশ্বিক বিনিয়োগ প্রতিবেদন-২০২০ প্রকাশ করে, তখন তারা পূর্বাভাস দিয়েছিল, ২০২০ সালে বৈশ্বিক বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরের অর্থাৎ ২০১৯ সালের তুলনায় কমপক্ষে ৪০ শতাংশ কমে যাবে। ২০১৯ সালে যেখানে বিশ্বজুড়ে মোট বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৫৪ হাজার কোটি ডলার, সেখানে চলতি বছর তা ১ লাখ ৮ হাজার কোটি ডলারে নেমে আসতে পারে—এমনকি আরও কমে ৯২ হাজার কোটি ডলারে গিয়েও ঠেকতে পারে।

প্রায় চার মাস আগে দেওয়া পূর্বাভাস যে অনেকটাই সত্যি হতে চলেছে, তার একটা প্রমাণ মিলল হালনাগাদ এই প্রতিবেদন থেকে। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, উন্নত দেশগুলোয় বিনিয়োগ এই সময়ে সবচেয়ে বেশি কমেছে। শুধু কমেছে বললে কম বলা হয়, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৭৫ শতাংশ কম। বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৬ শতাংশ। আঙ্কটাড বলছে, আশঙ্কা এর চেয়েও খারাপ ছিল।

লকডাউনের কুফল

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে লকডাউন আরোপ করা হয়। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল—সব দেশই এই পথে হাঁটে। কিন্তু অর্থনীতিতে তা মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। মাসাধিককালব্যাপী এই লকডাউন চলেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ে। এর জেরে বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নতুন বিনিয়োগ তো করেইনি, বরং বিদ্যমান বিনিয়োগও অনেক ক্ষেত্রে গুটিয়ে এনেছে বা সংকুচিত করেছে। আবার অনিশ্চয়তা ও গভীর মন্দার আশঙ্কায় অনেক নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পের অগ্রগতি থমকে গেছে।

২০১৯ সালে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া ও ব্রাজিলে এ বছরের প্রথমার্ধে এফডিআই সবচেয়ে বেশি হারে কমেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি এফডিআই প্রাপ্তির দেশ ভারতে এই সময়ে কমেছে ২৯ শতাংশ। তবে ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ছেই।

বিদেশি বিনিয়োগের একটি ধরন হলো ক্রসবর্ডার বা আন্তসীমান্ত মার্জার অ্যান্ড একুইজেশনস (এমঅ্যান্ডএ)। এর মানে হলো এক দেশের কোম্পানি আরেক দেশের কোম্পানির মালিকানা অধিগ্রহণ করে বা একাধিক দেশের কোম্পানি একত্র হয়ে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই আন্তসীমান্ত এমঅ্যান্ডএ বছরের প্রথম ৯ মাসে প্রায় ১৫ শতাংশ কমেছে—বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।

তবে ভারতে এই এমঅ্যান্ডএর আর্থিক মূল্য এই সময়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ফেসবুকের মালিকানাধীন জাড্ডু কর্তৃক জিও প্ল্যাটফর্ম ক্রয়সহ রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের বেশ কিছু কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ আসায় এমঅ্যান্ডএতে ভারত বেশ এগিয়েছে।

আবার গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ বছরের প্রথম আট মাসে ৩৭ শতাংশ কমে গেছে। বহুজাতিক কোম্পানি যখন অন্য কোনো দেশে একদম নতুন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বিনিয়োগ করে, তখন তাকে বলে গ্রিনফিল্ড। আর তাই আঙ্কটাড একে অভিহিত করেছে ভবিষ্যৎ বিদেশি বিনিয়োগের সূচক হিসেবে। এ ধরনের বিনিয়োগের পরিমাণ জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে ৩৫ হাজার ৮০০ কোটি ডলার বলে আঙ্কটাড প্রাক্কলন করেছে।

প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিনির্ভর হওয়ায় গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে গ্রিনফিল্ড বিনিয়োগ কমেছে ৭৮ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় কমেছে ৯৭ শতাংশ।