বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে এই উচ্ছ্বাস নাও টিকতে পারে

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য নিয়ে এই উচ্ছ্বাস নাও টিকতে পারে

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। বাংলাদেশ ও দারিদ্র্য যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। কয়েক দশক ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল সবচেয়ে ধীর গতির। দারিদ্র্য দূর করতে বা টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে দেশটির অগ্রগতি ছিল নগণ্য। অনেক শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক আশঙ্কা করেছিলেন আজীবন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হবে বাংলাদেশকে। দেশটি প্রকটভাবে নির্ভরশীল হয়ে থাকবে বৈদেশিক সহায়তার উপর। কেউ কেউ দেশটিতে মালথুসিয়ান বিপর্যয় ঘটতে পারে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, দেশটিতে বিদ্যমান খাবারের চেয়েও জনসংখ্যার পরিমাণ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল।

তবে এতসব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে, ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থান এবং ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য হ্রাস ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যাপক অগ্রগতি লাভ করেছে বাংলাদেশ।

গত মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এক পূর্বাভাসে জানিয়েছে, চলতি বছর মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ভারতকে ছাড়িয়ে যাবে দেশটি।

আইএমএফের পূর্বাভাসে উল্লেখিত দুই দেশের মধ্যকার ব্যবধান বেশ প্রকট। সংস্থাটির মতে, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১০.৩ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। অন্যদিকে, একই সময়ে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কিনারে টলটলায়মান থাকা হিসেবে বিবেচিত একটি দেশ কিভাবে এত নাটকীয়ভাবে উন্নতি লাভ করেছে? তার উপর ভারতকে অর্থনৈতিক অবস্থানে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, হোক তা কেবল মাথাপিছু আয়ের হিসেবে? এই প্রশ্নগুলোর সহজ উত্তর পাওয়া যায় গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও একই সময়ে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধীর গতি বিবেচনায় নিলে। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তুলে ধরায় ঢাকার সফলতা (আর এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা) প্রশ্ন জাগায়: ঠিক কিভাবে দেশটি এই অর্থনৈতিক বিস্ময় অর্জন করলো?

এর উত্তরগুলো জটিল। এক দিক দিয়ে, বাংলাদেশের সফলতা নেপথ্যে রয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো ব্যাপক অর্থ। এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই বাস করেন পারস্য উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোয়। এক কোটির বেশি বাংলাদেশি প্রবাসী প্রতি বছর গড়ে দেশটিতে ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলার পাঠিয়ে থাকেন। এই বিশাল আর্থিক অবদানের পাশাপাশি দেশে বেকারত্বের হার কমাতেও ভূমিকা রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের কাছাকাছি আয়তনের এই দেশটিতে ১৬ কোটির বেশি মানুষ বাস করে। তাছাড়া, প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশে দারিদ্রতা কমাতেও ভূমিকা রাখে।

কিন্তু বাংলাদেশের সফলতা কেবল রেমিট্যান্সের উপর ভিত্তি করেই আসেনি। দেশটির অর্থনীতির উন্নতির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তাদের পোশাক শিল্পের সাম্প্রতিক অসাধারণ সাফল্য। এই খাতে কাজ করে দেশের ৪০ লাখ মানুষ। প্রতি বছর দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে এই শিল্প থেকে। চীন ও ভিয়েতনাম যখন অন্যান্য খাতের দিকে নজর ঘুরিয়ে নেওয়া শুরু করে, বাংলাদেশ তখন সযত্নে এই শিল্পকে বাড়িয়ে তুলতে মনোনিবেশ করেছে। বাংলাদেশে নারীদের কর্মসংস্থানের প্রধান উৎসগুলোর একটি এই খাত। দেশটির আয়েরও গুরুত্বপূর্ণ উৎস হয়ে উঠেছে এটি। এই খাতে নারীদের কর্মসংস্থান, দেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক, উভয় ক্ষেত্রে নারী ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

উপরে বর্ণিত দুই খাত বাদে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতায় আরো একটি বিষয় ভূমিকা রেখেছে। যেখানে ভারত মূলত সামাজিক খাতে ছোটখাটো পরিবর্তন নিয়ে কাজ করেছে, সেখানে বাংলাদেশের একাধিক সরকার নিজ নিজ মতাদর্শিক বাধাকে অগ্রাহ্য করে মাতৃসেবা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। এসব পদক্ষেপ দেশটিতে শিশু মৃত্যুহার, অপুষ্টি কমিয়েছে ও বেশকিছু রোগের বিস্তার দমিয়ে রেখেছে।

কিন্তু ঢাকার বুদ্ধিদীপ্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা সত্ত্বেও দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুতর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের হাতে অবাধ রাজনৈতিক ক্ষমতা মজুদ থাকলে, সময়ের আবর্তে তারা দুর্নীতি ও লুটেরাতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। তেমনটা ঘটলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।

আরো বেশকিছু দেশের মতো, বাংলাদেশও দ্রুত গতিতে কর্তৃত্ববাদের দিকে ঝুঁকছে। দেশটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আছেন। পার্লামেন্টের সরাসরি নির্বাচিত ৩০০ আসনের ২৮৮টি আসনই তার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের দখলে। ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগের মধ্যে পুননির্বাচিত হন তিনি। এর আগে ওই বছর, দেশটির প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রধানকে দুর্নীতির দায়ে ১৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিরোধীদলটি অভিযোগ করেছে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

হাসিনা তার সরকারে বিরুদ্ধে কোনো বৈধ চ্যালেঞ্জ সহ্য করার মনোভাব প্রকাশ করেননি। তার সরকার বিদ্যমান ও নতুন সৃষ্ট আইন ব্যবহার করে ভিন্নমতপোষণকারী ও সমালোচকদের হয়রানি করেছেন, ভয় দেখিয়েছেন ও চুপ করিয়ে দিয়েছেন। এর সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ২০১৮ সালে বিশিষ্ট আলোকচিত্রশিল্পী ও অধিকারকর্মী শহিদুল আলমের গ্রেপ্তার। ঢাকার রাস্তার দুরাবস্থা নিয়ে বিক্ষোভকারী স্কুলশিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন জানানোয় তাকে আটক করা হয়। পরে অবশ্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তীব্র সমালোচনার মুখে তাকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে তা সত্ত্বেও আলমকে ১০০ দিনের বেশি কারাগারে থাকতে হয়। এ সময় তার উপর নির্যাতন চালানো হয়। তাকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রশ্নবিদ্ধ অভিযোগে। এর পাশাপাশি ব্যবহার করা হয় মধ্যযুগীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। এই আইন মূলত ভিন্নমতপোষণকারীদের দমাতে ব্যবহার করে হয়। ইন্টারনেটে বক্তব্য প্রকাশের উপর এর বিধান ব্যবহার করে বাংলাদেশ সরকার এখন সমালোচকদের ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারে।

ভিন্নমতপোষণকারীদের এভাবে দমানো একেবারেই কাম্য নয়। এটি গণতান্ত্রিক রীতিনীতি-বিরুদ্ধ। তার চেয়েও ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে, এর মাধ্যমে দুর্নীতি ও লুটেরাতন্ত্রের পথ সুগম হতে পারে। কেননা, এই আইনের কারণে ইলেকট্রনিক সংবাদমাধ্যমগুলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে নিরুৎসাহিত হতে পারে। দিনশেষে, সরকারের সুদৃষ্টিতে থাকতে ইচ্ছুক আবার নিজের মানও বাঁচাতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা এই আইনের সুরক্ষা চেয়ে বসতে পারে। বাকিরা সহজেই এই আইনের মাত্রাজ্ঞানহীন বিধানের শিকার হতে পারে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিশ্চিতভাবেই উদযাপন করার মতো একটি বিষয়। তবে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কেবল একটি খাতের—পোশাক শিল্প— ওপর নির্ভরশীলতা দেশটির অর্থনীতির ভবিষ্যতের জন্য ভালো নয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে পোশাক শিল্প রপ্তানি হয় সেই দেশগুলোয় অর্থনৈতিক মন্দা আসলে তা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে। আবার, দেশটি প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের উপরও আজীবন নির্ভর করে থাকতে পারবে না। করোনা মহামারির মধ্যে দেখা গেছে যে, মুহূর্তের মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকরা ঝরে পড়তে পারে।

সবশেষে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অংশবিশেষ সম্ভব হয়েছে দেশটির সবচেয়ে দরিদ্র্য গোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে। কর্তৃত্বপরায়ণতার কবলে পড়লে এই অগ্রগতিগুলো নিমিষেই মুছে যেতে পারে। তেমনটা হলে দেশের নীতিমালা তৈরি হবে অভিজাত শ্রেণির স্বার্থ বিবেচনায়। তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুজি রক্ষায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতা চলমান রাখতে, দেশটিকে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিতে ফিরে যেতে হবে, কিসিঞ্জারের কথায় দেশটি যখন বাস্কেট কেস ছিল সেসময়ের নীতিতে: অর্থাৎ, গণতন্ত্রে। সূত্র : ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন

এমজে/