ভাসানচরে যেতে দলে দলে ক্যাম্প ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা

ভাসানচরে যেতে দলে দলে ক্যাম্প ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা

স্বেচ্ছায় নোয়াখালীর ভাসানচরে যেতে চাওয়া রোহিঙ্গাদের কক্সবাজারের ঘিঞ্জি শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রায় ১০০ পরিবার উখিয়া কুতুপালংয়ের ট্রানজিট ও কলেজ মাঠের পয়েন্টে পৌঁছেছে। এসব পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে বলে জানান সেখানকার রোহিঙ্গারা। বুধবার (২ ডিসেম্বর) বিকালে টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের পাঁচ পরিবারের ২৭ জন সদস্য স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যাওয়ার জন্য সন্ধ্যায় উখিয়া ট্রানজিট পয়ন্টে পৌঁছায়।

বৃহস্পতিবারও (৩ ডিসেম্বর) ভাসানচর যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প ছাড়তে দেখা গেছে। উখিয়া কলেজের অস্থায়ী ট্রানজিট ঘাট থেকে দুই ভাগে আজ সন্ধ্যায় ভাসানচরের উদ্দেশে তাদের যাত্রা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।

এ বিষয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি এবং টেকনাফ শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা (সিআইসি) নওশের ইবনে হালিম বলেন, ‘বুধবার বিকালে বাসে করে আমার ক্যাম্প থেকে পাঁচটি রোহিঙ্গা পরিবারকে উখিয়ার কুতুপালংয়ের ট্রানজিট পয়েন্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাদের সেখান থেকে কখন কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে, সে বিষয়ে আমার জানা নেই।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা জানান, ‘স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ক্যাম্প ত্যাগ করেছে। তাদের উখিয়ার কুতুপালংয়ের ট্রানজিট পয়েন্ট ও কলেজ মাঠে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গাদের এই দলটিকে নিরাপত্তার সঙ্গে ভাসানচর নিয়ে যাওয়ার জন্য চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। পরে সেখান থেকে তাদের ভাসানচরে হস্তান্তর করা হবে।’

এদিকে টেকনাফের শামলাপুর শরণার্থী শিবিরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কিছু রোহিঙ্গা পরিবার মালপত্র নিয়ে ক্যাম্প ইনচার্জের (সিআইসি) কার্যালয়ে পৌঁছেছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তাদের সঙ্গে কথা হয়। এ সময় এই ক্যাম্পের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

সালামত উল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গা জানিয়েছেন, উখিয়ায় কুতুপালংয়ের ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে বৃহস্পতিবারই ভাসানচরের উদ্দেশে তারা রওনা করবেন বলে শুনেছেন। টেকনাফ শামলাপুরের এই রোহিঙ্গা বলেন, ‘সাগরে মাছ শিকার করে সংসার চালাতাম। এখন ভালো জীবনের আশায় ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে যাচ্ছি। পুরনো ঘরসহ মালপত্র আট হাজার টাকায় পাশের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। প্রথম আমাদের এখান থেকে উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্টে নিয়ে যাবে। পরে সেখান থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষ করে এখানে খুব কষ্টের জীবন যাচ্ছিল। তাই উন্নত জীবনের আশায় স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সেখানে চলে যাচ্ছি। নিজেদের ইচ্ছাতেই যাচ্ছি আমরা।’

শারমিন আক্তার (২০) নামে আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, ‘এখান থেকে ভাসানচরে খুব ভালো হবে। তাই আমরা পুরো পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছি। তাছাড়া এর আগে ৩০ নভেম্বর এই ক্যাম্পে সিআইসি কার্যালয়ে আমরা সবাই মিটিং করেছি। সেখানে বলা হয়, যারা ভাসানচরে ইচ্ছুক তাদের প্রস্তুতি নিতে। বৃহস্পতিবার ভাসানচরে যাত্রা শুরু হবে, এর জন্য আমাদের প্রস্তুতি শেষ। ফলে আমরা আগে থেকে ঘরসহ সব পুরনো আসবাবপত্র বিক্রি করে দিয়েছি। উন্নত জীবন দেখছি, তাই সেখানে পাড়ি দিতে রাজি হয়েছি। সেখানে আমাদের থাকার জন্য ঘরসহ চাষাবাদ করতে জমিজমা দেওয়ার কথা বলছে মাঝিরা। আমরা চলে যাবো খবর পেয়ে আত্মীয়স্বজনরা দেখা করতে এসেছে। আমরা সেখানে যাওয়ার পর ভালো হলে স্বজনরাও যেতে রাজি হবেন। এই পুরো ক্যাম্প থেকে মোট ২৬ পরিবার ভাসানচরে যাচ্ছে বলে শুনেছি।’

নোয়াখালীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) দীপক জ্যোতি খীসা বলেন, ‘কক্সবাজারের শরাণার্থী শিবির থেকে কাল-পরশু (বৃহস্পতিবার-শুক্রবার) রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ভাসানচরে হস্তান্তর করার কথা রয়েছে। আমাদেরও সেভাবে প্রস্তুতি রয়েছে।’

টেকনাফের শামলাপুর রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি আবুল কাশেম জানান, তার শিবির থেকে বুধবার বিকাল পর্যন্ত পাঁচটি পরিববার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ক্যাম্প ছেড়েছে। স্থানান্তর সংশ্লিষ্টরা তাদের বাসে করে উখিয়ার কুতুপালংয়ের ট্রানজিট পয়েন্টে নিয়ে যান। বৃহস্পতিবার তার ক্যাম্প থেকে আরও বেশ কিছু পরিবার নিয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে।

এদিকে ভাসানচরের আবাসন প্রকল্প দেখে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় যেতে ইচ্ছুক সাড়ে তিনশ পরিবারের আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নোয়াখালী ভাসানচরে হস্তান্তর শুরু করতে সব প্রস্তুতি শেষ করার কথা জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

৩ ও ৪ ডিসেম্বর ভাসানচরে রোহিঙ্গা হস্তান্তরের কথা রয়েছে উল্লেখ করে সম্প্রতি আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)-এর অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোশারফ হোসেন জানিয়েছিলেন, অতি দ্রুত নতুন করে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে আড়াই হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে হস্তান্তর করা হবে। ফলে তাদের নিরাপত্তা দায়িত্বে পালনে কর্মকর্তাসহ ৯ ও ২ এপিবিএনের নতুন করে ২২২ জন পুলিশ সদস্য সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তারা সেখানে গড়ে তোলা আবাসন প্রকল্পে উঠবেন।

এপিবিএনের আইজিপি আরও বলেন, আগে থেকেই ভাসানচরে এপিবিএনের ৩০ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। ইতোমধ্যে ভাসানচর নিয়ে তাদের পরিকল্পনা পুলিশ হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়েছে।

এর আগে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজা জানিয়েছিলেন, স্বেচ্ছায় কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হওয়ায় তাদের সেখানে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে বুধবার তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, নিপীড়ন ও হত্যার কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে থেকেই বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ক্যাম্প নির্মাণ করে তাদের আশ্রয় দিলেও তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি বরাবরই দাবি জানিয়ে আসছে। এ ব্যাপারে জোরালো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এরপরও আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক নানা সুযোগ সুবিধার ব্যাপারও সরকারকে ভাবাচ্ছে।

এ পরিস্থিতির মধ্যেই রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের ঘিঞ্জি ক্যাম্পগুলো থেকে সরিয়ে আরও নিরাপদে রাখতে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে বিপুল ব্যয়ে আশ্রয় ক্যাম্প নির্মাণ করে সেখানে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভাসানচরের আশ্রয় ক্যাম্পে কমপক্ষে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে।

জানা গেছে, সম্প্রতি রোহিঙ্গা নেতাদের ভাসানচরে নিয়ে গিয়ে দ্বীপটি এবং সেখানে নির্মিত অবকাঠামো তাদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়। ক্যাম্পে ফিরে এসব নেতার অনেকে নানা ধরনের মত প্রকাশ করেন। তবে ঘিঞ্জি বস্তিতে কষ্টে দিনযাপন করা রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভাসানচরের আশ্রয় গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছেন। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাও ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের লোকজনকে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। এরপর অন্তত সাড়ে ৩০০ রোহিঙ্গা পরিবার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে ধাপে ধাপে এসে ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহের কথা জানান। এরপরই তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে সরকার।

তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের এই দলটিই প্রথম আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে না। এর আগে গত মে মাসে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দুই দফায় নারী-শিশুসহ মোট ৩০৬ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ফিরে আসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সঙ্গনিরোধের জন্য সরকার তাদের ভাসানচরে নিয়ে রেখেছে।

এমজে/