আটক আর্টিস্টদের অবিলম্বে ও শর্তহীন মুক্তি দাবি অ্যামনেস্টির

আটক আর্টিস্টদের অবিলম্বে ও শর্তহীন মুক্তি দাবি অ্যামনেস্টির

আর্টিস্টদের সম্প্রতি খেয়ালখুশিমতো আটক ও অন্য উপায়ে হয়রানির কারণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

২১শে জানুয়ারি নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, বাংলাদেশে মুক্ত মত প্রকাশের অধিকারের ক্ষেত্রে এসব আর্টিস্ট ক্রমবর্ধমান হারে হুমকি মোকাবিলা করছেন। তাদের ভাষায়, যেসব আর্টিস্টকে বেআইনিভাবে আটক করা হয়েছে, অবিলম্বে এবং শর্তহীনভাবে তাদের সবার মুক্তি দাবি করছি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাচ্ছি। আহ্বান জানাই আর্টিস্টদের অভিব্যক্তি এবং সৃষ্টিশীলতার অবাধ অধিকারের প্রতি নিশ্চয়তা নিশ্চিতের।

অ্যামনেস্টি লিখেছে, ডিসেম্বরে ঢাকাভিত্তিক একজন চলচ্চিত্র পরিচালক অনন্য মামুন (৩৪) তার সর্বশেষ ছবি ‘নবাব এলএলবি’-এর ট্রেইলার প্রকাশ করেন। এতে অভিনেতা শাহিন মৃধাকে (৪৬) একজন অনুসন্ধানকারী পুলিশ কর্মকর্তার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখা যায়। তিনি ধর্ষণের শিকার এক নারীকে আইনগত প্রতিকার নেয়ার ক্ষেত্রে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেন।

ছবির দৃশ্যে দেখানো হয় ওই পুলিশ কর্মকর্তা ধর্ষিতাকে অনধিকার প্রশ্ন করছেন। বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীরা নিয়মিত এমন তিক্ত বাস্তবতার মুখোমুখি হন। এই ছবির ট্রেইলার প্রকাশের পর ২৫ শে ডিসেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সাইবার ক্রাইম ইউনিট দু’আর্টিস্টের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১২-এর অধীনে মামলা করে। এতে অভিযোগ করা হয়, অত্যন্ত আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি এবং ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, যা জনগণের মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করবে।

অ্যামনেস্টি বলেছে, এমন সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিন্দা জানিয়েছেন স্থানীয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা। তারা একে দেশে আর্টিস্টদের মুক্ত মত প্রকাশের বিরুদ্ধে হুমকি হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ বছর ১১ই জানুয়ারি অভিযুক্ত আর্টিস্টদের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাদেরকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে বিচার প্রক্রিয়া স্থগিত আছে। ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে করা মামলায় নারী লোকসঙ্গীত শিল্পী রিতা দেওয়ান ও তার দুই কন্যার বিরুদ্ধে ডিসেম্বরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ঢাকার একটি আদালত। তাদের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারিতে ওই মামলা করা হয়েছিল।

মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, রিতা ও তার দু’মেয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। গত বছর ১লা ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে একটি পালাগান অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করছিলেন রিতা। সেখানে তিনি তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিতর্ক করছিলেন। এ মামলায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, তারা অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮(১) ধারার অধীনে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া একটি অপরাধ, তবে তা অস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত। এ অপরাধে কোনো ব্যক্তির সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। ওই সঙ্গীত পরিবেশনের অনুষ্ঠান পর থেকে একই রকম অভিযোগে রিতার বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা খারিজ করে দিয়েছে আদালত। অন্য তিনটি এখনও বিচারাধীন। তবে মুলতবি অবস্থায় রয়েছে। এ বছর ১৩ই জানুয়ারি ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল রিতাকে একটি মামলায় জামিন দিয়েছে।

গত বছর মে মাসে সুপরিচিত কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর এবং লেখক মুশতাক আহমেদকে তাদের ঢাকার বাসভবন থেকে ডিজিটাল নিরাপাত্তা আইনের অধীনে আটক করা হয়। অভিযোগ, তারা করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে ফেসবুকে গুজব ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা জাতির জনক, জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন। আন্তর্জাতিক পুরস্কার বিজয়ী কার্টুনিস্ট কিশোর। তিনি সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও তাদের নীতির বিষয়ে ব্যঙ্গাত্মক, সমালোচনামুলক চিত্র অঙ্কনের জন্য বেশ পরিচিত। তার সাম্প্রতিক এমন কাজ প্রকাশিত হয় ফেসবুক। এর শিরোনাম দেয়া হয়- করোনাকালে জীবন। ফেসবুকে তার ‘আই অ্যাম বাংলাদেশ’ পেইজে প্রকাশিত হয়েছিল এসব। এতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের দুর্নীতির সমালোচনা করা হয়। অন্যদিকে ‘কুমির চাষের ডায়েরি’ বইয়ের লেখক মুশতাক আহমেদ। তিনি ‘মাইকেল কুমির ঠাকুর’ নামে ফেসবুকে একটি পেইজ চালান। এতে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতে কমেন্ট পোস্ট করা হতো। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ নম্বর ধারার অধীনে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এই অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং/অথবা ৩ কোটি টাকা জরিমানা করা হতে পারে, যদি দেখা যায় তারা অতিরঞ্জিত প্রগাপাণ্ডা চালিয়েছেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দীপনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন, জাতির জনকের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন, জাতীয় সঙ্গীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন।

২০২০ সালের মে মাসে গ্রেপ্তারের পর থেকেই কিশোর এবং মুশতাককে আটকে রাখা হয়েছে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। আদালতে তাদের জামিন আবেদন বার বার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে তাদের সঙ্গে জেলখানায় পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতে বিধিনিষেধ রয়েছে। অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে কিশোর একজন ইনসুলিন-নির্ভর ডায়াবেটিসের রোগী। কোভিড-১৯ এর কারণে তার রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তার স্বাস্থ্যগত অবনতিশীল পরিস্থিতিতে অবিলম্বে কিশোরের মুক্তি দাবি করেছে জাতিসংঘের তিনজন স্পেশাল র‌্যাপোর্টিউর।

২০১৮ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ‘অনলাইনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের কণ্ঠরোধ’ বা ‘মাজলিং ডিসেন্ট অনলাইন’ শীর্ষক রিপোর্টে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, কিভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী। এ জন্য তারা ধারা ২১ সহ নির্যাতনমূলক দমনপীড়নমূলক ধারাগুলো বাতিল করতে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানায়। তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে আহমেদ কবির কিশোর ও লেখক মুশতাক আহমেদকে অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে। একই সঙ্গে আর্টিস্ট অনন্য মামুন, শাহিন মৃধা, রিতা দেওয়ান, কিশোর এবং মুশতাকের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহার করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

একই সঙ্গে তারা বলেছে- ‘আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি জরুরিভিত্তিতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ বাতিল করার আহ্বান জানাই অথবা দমনমূলক বিধিগুলোকে সংশোধন করার আহ্বান জানাই। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের আইনের অধীনে বাধ্যবাধকতাগুলোকে সমুন্নত রাখতে হবে বাংলাদেশকে এবং ভীতিহীনভাবে আর্টিস্ট ও সৃষ্টিশীল মত প্রকাশকে নিশ্চিত করার স্থান দিতে হবে’।