পাহাড়ে হত্যা, অপহরণের নেপথ্যে কী?

পাহাড়ে হত্যা, অপহরণের নেপথ্যে কী?

পাহাড়ে হত্যা, অপহরণের নেপথ্যে কী?
ঢাকা, ২১ মার্চ (জাস্ট নিউজ) : অপহরণের দুইদিন পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলকার দুই নারী নেত্রীকে উদ্ধার করা যায়নি৷ এ অপহরণের ঘটনায় পাহাড়ি সংগঠনগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করছে৷ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হয়েছে৷

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও রাঙামাটি জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক দয়া সোনা চাকমাকে অস্ত্রের মুখে গত রবিবার সকালে কুতুকছড়ি এলাকা থেকে অপহরণকরা হয়৷ এ ঘটনার প্রতিবাদে বুধবার (২১ মার্চ) খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলায় সকাল-সন্ধ্যা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সমর্থিত তিনটি পাহাড়ি সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ও হিল উইমেন্স ফেডারেশন৷

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙামাটি জেলা সভাপতি রূপসী চাকমা ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, মুখোশ বাহিনী (ইউপিডিএফ-গণতন্ত্র) নামে পরিচিত একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাঁদের অপহরণ করেছে৷ অপহৃতদের এখনো কোনো খোঁজ পওয়া যায়নি৷

রবিবার দুপুরে দুই নারী নেত্রীকে অপহরণের পর ইউপিডিএফের রাঙামাটি জেলা ইউনিটের সংগঠক সচল চাকমা ও বিকেলে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিরূপা চাকমা আলাদা আলাদা বিবৃতিতে এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, রোববার সকাল সোয়া ৯টার দিকে কুতুকছড়ি আবাসিক এলাকার গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের নেতা ধর্ম সিং চাকমার বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালায় নব্য মুখোশ বাহিনীর সস্ত্রাসীরা৷ সন্ত্রাসীরা গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম ও পিসিপি'র দুই নেতাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে৷ এতে যুব ফোরামের রাঙ্গামাটি জেলা আহ্বায়ক ধর্মশিং চাকমা পায়ে গুলিবিদ্ধ হন৷ মুখোশ বাহিনীর সস্ত্রাসীরা এসময় ছাত্রদের একটি মেসে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ ভয়ে সবাই পালিয়ে গেলে দৃর্বৃত্তরা দুই নারীকে অপহরণ করে৷

ইউপিডিএফ ভেঙ্গে গত বছরের ১৭ নভেম্বর ইউপিডিএফ গণততন্ত্র নামে আলাদা সংগঠন করা হয় তপন জ্যোতি চাকমা'র নেতৃত্বে৷ সেই থেকে দুই ভাগে বিভক্ত সংগঠনের নেতারা পরস্পরকে ‘সরকারের দালাল' এবং ‘সন্ত্রাসী' বলে আখ্যা দিয়ে আসছে৷

ইউপিডিএফ (গণতন্ত্র) মূখমাত্র তপন জ্যোতি চাকমা ডয়চে ভেলের কাছে দাবি করেন, ওই দুই নারী নেত্রীকে অপহরণের সঙ্গে আমরা কোনোভবেই জড়িত না৷ তারা নিজেরাই জানে, ওই দুই নারী কোথায় আছেন৷ তা না হলে তারা কিভাকে জানেন যে, তাদের বিয়ের আয়োজন করা হচ্ছে৷ তাদের নেতারা বলছেন আমরা মুক্তিপণ দাবি করছি৷ আমার প্রশ্ন, আমরা কোথায় কত টাকা মুক্তিপন দাবি করেছি তার প্রমাণ কী?

তিনি আরো বলেন, আসলে তারা এখন আন্দোলন করে, অবরোধ করে রাজনীতি করতে চাইছে৷ তাই এ ধরনের কথা বলছে৷ তারা নিজেরা সব জানে৷

মূল ইউপিডিএফ-এর সহযোগী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন দুই নারীনেত্রীকে অপহরণের জন্য সরাসরি ইউপিডিএফ-এর বের হয়ে যাওয়া অংশকে দায়ী করলেও ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকারি বাহিনীর সহযোগিতায় সন্ত্রাসীরা হাটের দিন সকালে কুদুকছড়িতে হামলা চালায় এবং দু'জন নারীকে অপহরণ করে৷

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ইউপিডিএফ-গণতন্ত্র নামের কোনো সংগঠনের কার্যক্রম নাই৷ তাদের কোনো অস্তিত্ব নাই৷ কিছু সন্ত্রাসী সরকারের দালাল হিসেবে কাজ করে আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে৷

পাহাড়ে থেমে নেই অপহরণ, গুম, খুন ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা৷ দিন দিন এসব বেড়ে যাওয়ার কারনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কর্মী, নারী নেত্রীসহ সাধারণ মানুষ৷ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, নিজেদের অন্তঃকোন্দলের শিকার হচ্ছেন পাহাড়ের মানুষ৷ আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি এবং এলাকা বিস্তারের কারণে কিছু দিন পরপর খুন, গুম ও অপহরণের ঘটনা এখন নিয়মিত ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে৷

পাহাড়ে এখন পাহাড়িদের সংগঠনগুলো দুইভাগে বিভক্ত৷ শান্তি চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষের কথা বলেই এই বিভক্তি৷ ফলে পাহাড়ে অপহরণ, গুম, খুন ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে৷ অভিযোগ আছে, আঞ্চলিক দলগুলোর চাঁদাবাজি এবং এলাকায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে কিছু দিন পরপর খুন, গুম ও অপহরনের ঘটনা ঘটছে৷

শান্তিচুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ ইস্যুতে ২০০৯ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ভেঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা ) নামের আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে৷

পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দাবিতে গঠিত ইউপিডিএফ গত বছরের নভেম্বরে দুই ভাগ হয়ে যায়৷ তাই পাহাড়ে এখন চারটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয়৷ তারা আবার পরস্পরের প্রতিপক্ষ৷

এদিকে রাঙামাটি কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ সত্যজিৎ বড়ুয়া দুই নারীকে অপহরণের বিষয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত কেউ আমাদের কাছে অপহরণের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ করেননি৷ তবে আমরা মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছি৷ দুর্গম এলাকা হওয়ার কারণে অভিযান পরিচালনায় সময় লাগছে৷

ইউপিডিএফ-এর দুই গ্রুপের নেতারাই ডয়চে ভেলের কাছে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন৷তাঁদের কথায় স্পষ্ট যে, গত কয়েক বছরে তাঁদের কোন্দলে হামলা, অপহরণ ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷

রাঙামাটির সাংবাদিক জিয়াউল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বিভক্তির প্রধান কারণ আর্থিক৷ আর সে কারণেই তারা এলকাভিত্তিক আধিপত্য বাড়াতে চায়৷ আর এই অর্থ আদায়কে কেন্দ্র করেই হত্যা, অপহরণ বা হামলার ঘটনার একাংশ ঘটে৷

তবে তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাদের কোন্দলের সুযোগও নেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ তারা বলে, দুর্গম এলাকার এসব ঘটনায় আমাদের কিছু করার থাকে না৷ ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা দাবি করেন, পাহাড়িদের আন্দোলন দমাতে সরকারের নানা সংস্থা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে৷ তাদের ছত্রছায়ায় হামলা, অপহরণসহ নানা ঘটনা ঘটে৷ আমরা দুই নারীকে অপহরণের ঘটনা পুলিশকে জানালেও পুলিশ তাঁদের উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ -ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/০৯৪৯ঘ.)