দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যার একযুগ

দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যার একযুগ

তৎকালীন বিডিআর সদর দফতরে দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের নৃশংসভাবে হত্যাযজ্ঞের ১২ বছর পূর্তি আজ, শোকাবহ পিলখানা ট্র্যাজেডি দিবস। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদর দফতরে বিপথগামী সদস্যরা কিছু দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে তান্ডব চালায়। ওই দু দিনে তৎকালীন বিডিআরের মহাপরিচালক (ডিজি)সহ ৫৭ জন চৌকস সেনা কর্মকর্তা এবং নারী ও শিশু ছাড়াও আরও ১৭ জনকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা।

দীর্ঘ ১২ বছরেও ওই নির্মম হত্যাকান্ডের শোক কাটিয়ে উঠতে পারেননি নিহতদের স্বজনরা। শোকাবহ এ ঘটনায় নিহতদের স্মরণে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন।

ঘটনাক্রম : হাইকোর্টে জমা হওয়া মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছিল তৎকালীন বিডিআরের বার্ষিক দরবারের দিন। অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৯টায় সদর দফতরের দরবার হলে। সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, উপমহাপরিচালক (ডিডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারী, বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তাসহ বিডিআরের নানা পদের সদস্যরা। সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে, ওই দিন দরবারে উপস্থিত ছিলেন ২ হাজার ৫৬০ জন।

দরবার শুরুর পর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে দুজন বিদ্রোহী জওয়ান অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন, একজন ছিলেন সশস্ত্র। শুরু হয় বিদ্রোহ। দরবার হলের বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিদ্রোহীরা কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন। ডিজির নেতৃত্বে কর্মকর্তারা দরবার হলের বাইরে পা রাখা মাত্র মুখে কাপড় ও মাথায় হলুদ রঙের হেলমেট পরা চারজন ডিজিকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করেন।

ডিজির পর হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে। এরপর পিলখানার ভেতরে ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা। এ সময় প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে বিদ্রোহীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ও সরিয়ে ফেলা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি বেলা আড়াইটায় টেলিভিশন ও বেতারে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণ করে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে। এছাড়া তৎকালীন বিডিআরের কিছু কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন। সন্ধ্যা ৬টা থেকে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ শুরু করেন।

বিডিআর বিদ্রোহ : এক যুগেও পেছনের কারণ অজানা বিডিআর বিদ্রোহ ইতিহাসের এক ন্যক্কারজনক ঘটনা। তবে ১২ বছরেও বিদ্রোহের পেছনের কারণ অজানা রয়ে গেছে। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বিডিআরের বিপথগামী সদস্যরা দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে পিলখানায় নারকীয় তান্ডব চালায়। মহাপরিচালক (ডিজি)সহ তারা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তারা।

ঘটনার পর বিদ্র্রোহ তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। সাবেক সচিব মো. আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি বিদ্রোহের জন্য বাহিনীর অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছিল। একই সঙ্গে ঘটনার পেছনের কারণ বা নেপথ্যের কারণ তদন্তের সুপারিশ করে। আর পিলখানায় ঘটে যাওয়া দু দিনের ঘটনার পর হত্যা মামলা এবং বিস্ফোরক মামলা তদন্ত করে সিআইডি।

হত্যা মামলার বিচার সম্পন্ন: পিলখানায় নারকীয় হত্যায় দায়ের করা হয় দুটি মামলা। এর মধ্যে সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় দন্ডবিধি আইনে করা হয় হত্যা মামলা। অপরটি হয় বিস্ফোরক আইনে। দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ১৫২ জনকে মৃত্যুদন্ড দেন। পরে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে আপিলের রায়ে ১৩৯ জনের মৃত্যুদন্ডের রায় বহাল রাখা হয়। আটজনের মৃত্যুদন্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন এবং চারজনকে খালাস দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ পাওয়া ১৬০ জনের মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখা হয়। হাইকোর্টে আপিল চলার সময়ে কারাগারে দুজনের মৃত্যু হয়। খালাস পায় ১২ জন আসামি।

বিস্ফোরক আইনের মামলা : ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বিস্ফোরক আইনের মামলাটি। এই মামলায় আসামি রয়েছে ৮৩৪ জন। এর মধ্যে একজন সিভিলিয়ান, বাকি আসামিরা বিডিআরের জওয়ান। এই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জন মারা গেছেন। জীবিত আসামি ৭৯০ জন। পলাতক রয়েছেন ২০ জন। মামলায় ১৪৬ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রায় ১২শ সাক্ষী রয়েছে। আগামী ৮ মার্চ পরবর্তী সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। মামলার বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়া প্রসঙ্গে এই মামলার আইনজীবী বলেন, বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। তবে আসামি পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে খুব একটা উপস্থিত হচ্ছেন না বলে বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে হচ্ছে। তবে এই মামলায় সব সাক্ষীর প্রয়োজন নেই। মোটামুটি একটা পর্যায়ে গেলেই মামলার বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। আশা করছি এ বছরের মধ্যে রায় দেয়া সম্ভব হবে।