১২ জেলায় সীমান্ত নদী উন্নয়ন প্রকল্প

কাজ করে না ঠিকাদার, তদবিরে ব্যস্ত পাউবো

কাজ করে না ঠিকাদার, তদবিরে ব্যস্ত পাউবো

এক সাব-ঠিকাদারের অবহেলায় ডুবতে বসেছে ১২ জেলায় চলমান সীমান্ত নদীতীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ৩১৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পটির কাজ গত বছরের ২১ জুন শেষ করার কথা। সেখানে সোয়া দুই বছরে ওই প্রতিষ্ঠান মাত্র ২৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ কাজ বাস্তবায়ন করেছে।

এরপরও ৪০টি প্যাকেজের কাজ তার হাতেই ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ, কার্যাদেশ বাতিল না-করতে ওই সাব-ঠিকাদার ভিআইপিদের দিয়ে তদবির করাচ্ছেন। আর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বা পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ব্যস্ত সে তদবির রক্ষায়। অথচ সময়মতো কাজ না হওয়ায় ইতোমধ্যে নদীতীরের মূল্যবান ভূসম্পদ ধ্বংস হয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে কাজ বাস্তবায়ন না হলে আগামী বর্ষায় বিলীন হয়ে যেতে পারে কিছু বসতি এলাকাও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারত থেকে আসা নদীর যেখানে পাহাড়ি ঢলের স্রোতে তীর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে -এমন বাঁকে বাঁকে ব্লক বসানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৭ সালের ১৬ আগস্ট এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক আদেশ জারি হয়। নেওয়া হয় সীমান্ত নদীতীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন (ফেজ-২) প্রকল্প। ২০১৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর প্রকল্প বাস্তবায়নে খুলনার একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে পাউবো। চুক্তি অনুযায়ী ২০২০ সালের ২১ জুন এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

এরপর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ বাস্তবায়নের জন্য মতিঝিলের ডলি কনসোর্টিয়ামকে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। ১২ জেলার ৯টি নদীর তীরবর্তী এ কাজ বাস্তবায়নের সুবিধার্থে মোট ৭৭টি প্যাকেজে ভাগ করে পাউবোর প্রকৌশলীরা। নির্ধারিত সময় পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাজের অগ্রগতি ছিল মাত্র ২৩ দশমিক ৭০ শতাংশ। বিপরীতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে পরিশোধ করা হয়েছে ৬৫ কোটি টাকারও বেশি। সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে ২৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা বিল নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান আর কোনো কাজই করেনি।

দুবছরে কাজের ধীরগতিতে হতাশ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। গতি বাড়াতে দফায় দফায় চিঠি লেখেন প্রকল্পটির পরিচালক। একপর্যায়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ডলি কনসোর্টিয়ামের হাতে থাকা ৭৭টি প্যাকেজের মধ্যে ৩২টি প্যাকেজের কাজ বাতিল করা হয়। ওইসব প্যাকেজে টেন্ডারের মাধ্যমে নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করে পাউবো।

সূত্রমতে, বাকি ৪৫ প্যাকেজের মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে একটি করানো হয়েছে, বিএসএফের বাধায় আটকা আছে চারটি। অন্য ৪০টি প্যাকেজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব এখনো ডলি কনসোর্টিয়ামের হাতেই।

৬৫ কোটির বেশি টাকা পেয়েও কেন কাজ করছে না ডলি কনসোর্টিয়াম -এ প্রশ্নের উত্তর জানতে যোগাযোগ করা হয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। অনেকেই কথা বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পাউবোর এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘অন্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একজন ভিআইপি ডলি কনসোর্টিয়ামের মালিক নাসির উদ্দিনের পক্ষে তদবির করছেন। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দুজন ভিআইপি-ও একই তদবির করে যাচ্ছেন। যে কারণে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পাউবো কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

যিনি তদবির করছেন তাকে প্রকল্পের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কি না -জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, বলবে কে? যারা বলবেন তারাও তো এখন সেই একই তদবিরে ব্যস্ত। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, দরপত্র ছাড়াই কাজ ভাগিয়ে নিতে ২০ জন দালাল মন্ত্রণালয়ে সক্রিয় আছে। তারা আগাম পার্সেন্টেজ নিয়ে সরে যায়। পরে কাজের বাস্তবায়নের গতি কমে যায়।

সূত্রমতে, যে প্যাকেজগুলো ডলি কনসোর্টিয়ামের হাতে রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন শেষ করতে ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এভাবে সময়ক্ষেপণ করা হলে সীমান্ত নদীর কী পরিমাণ ক্ষতি হতে পারে, তা উঠে এসেছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রকল্পটির পরিচালক পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরীর গোপন প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পূর্বনির্ধারিত কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় শুধু গত বর্ষা মৌসুমে ভাঙনের কারণে নদীতীরের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গিয়েছে। এতে বাংলাদেশ অমূল্য ভূখণ্ড হারিয়েছে।

ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার সীমান্ত এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীতীরে ডাম্পিংয়ের জন্য বানানো সারিবদ্ধভাবে রাখা ব্লকগুলোর ফাঁকে ফাঁকে গাছ উঠে গেছে। অথচ এগুলো ডাম্পিং করা হচ্ছে না। সাইটে কোনো মানুষজনও নেই। এ যেন একটি পরিত্যক্ত যুদ্ধক্ষেত্র।

সূত্র জানায়, কয়েকদিন পরপর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এই প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি দেখতে যান। কিন্তু কাজের এই পরিণতি দেখে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি কাড়তে প্রতিবেদনও দেন। কিন্তু কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নবকুমার চৌধুরী বুধবার বলেন, ‘যে ৩২টি প্যাকেজের কাজ টেন্ডারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার বেশ কয়েকটি শেষ হয়ে গেছে। অন্য ৪৫টি প্যাকেজের মধ্যে কয়েকটি বিএসএফের বাধার কারণে আপাতত বন্ধ আছে। প্রায় ৪০টি প্যাকেজ নিয়ে হতাশাগ্রস্ত অবস্থানে আছি। আশা করছি, মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত দেবে।’

ডলি কনসোর্টিয়ামের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, ‘প্রজেক্টগুলো খুবই দুর্গম এলাকায়। ব্যাংকের লোন নিয়ে কাজ করছি। বিল পেতে সমস্যা হয়, ফান্ড নেই। এভাবে আমরা কাজ করলে তো দেউলিয়া হয়ে যাব। এ কারণে এক বছরের সময় চাওয়া হয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘৬৫ কোটি টাকা পেয়েছি। আমি যে কাজ করেছি তার জন্য আরও ১৩ কোটি টাকা পাব।’

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক একেএম ওয়াহিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চুক্তি তো হয়েছে অন্য জায়গায়। তাই প্রকল্পটিতে এখন যারা কাজ বাস্তবায়ন করছেন, তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো কথা হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাহী প্রকৌশলীদের একটি নির্দেশনা দেওয়া আছে। আশা করছি, এ বিষয়টির সমাধান কয়েকদিনের মধ্যেই হবে।-যুগান্তর

এমজে/