ইরফান সেলিমের জামিন, ব়্যাবের সত্য বনাম পুলিশের সত্য

ইরফান সেলিমের জামিন, ব়্যাবের সত্য বনাম পুলিশের সত্য

এমপি হাজী সেলিমের পুত্র ইরফান সেলিম শেষ পর্যন্ত অস্ত্র এবং মাদক আইনের দুইটি মামলা থেকেই অব্যাহতি পেয়েছেন৷ আর ভ্রাম্যমাণ আদালতের শাস্তি এখনো বহাল থাকলেও তাতে তিনি জামিন পেয়েছেন৷

বাকি আছে শুধু নৌবাহিনীর কর্তকর্তাকে মারধর ও হত্যা চেষ্টা মামলায় জামিন৷

অস্ত্র এবং মাদক আইনের দুইটি মামলারই বাদি র‌্যাব৷ গত বছরের ২৫ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডি এলাকায় নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহমেদ খানকে মারধরের পরদিন র‌্যাব ইরফান সেলিমের চকবাজারের বাসায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও মাদকসহ তাকে আটক করে৷ তার ভিত্তিতেই মামলা করে৷ ওই একই দিন র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাকে অবৈধভাবে ওয়াকিটকি রাখা এবং মাদক সেবনের অভিযোগে মোট দেড় বছর কারাদণ্ড দেয়৷

চকবাজার থানা পুলিশ তাদের তদন্তে র‌্যাবের দুই মামলায় ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি৷ তবে র‌্যাবের মিডিয়া উইং-এর পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম বৃহস্পতিবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘র‌্যাবের একজন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতেই ইরফান সেলিমের বাসায় অভিযান চালানো হয়৷ সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে তাদের সাক্ষী রেখেই অভিযান শেষ করা হয়৷ অভিযানে যা পাওয়া গেছে তাই উল্লেখ করেই র‌্যাব এজাহার করেছে৷ আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে চাই, অভিযানটি সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা হয়৷’’

তবে তিনি বলেন, পরবর্তীতে তদন্তকারী কর্মকর্তার বিচার বিশ্লেষণ, বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার ব্যাপারে তার কোনো ধারণা নেই৷
র‌্যাব আদালতে তাহলে তদন্ত প্রতিবেদনের ব্যাপারে আপত্তি বা নারাজি কেন দিলনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘নারাজির বিষয়টি র‌্যাবের আইন কর্মকর্তারা আমলে নিয়ে যাচাই বাছাই করছেন৷’’

তদন্ত নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি চকবাজার থানার ওসি৷ তবে ডিএমপির অতিরিক্ত উপ কমিশনার (জনসংযোগ) ইফতেখারুল ইসলাম দাবি করেন, ‘‘পুলিশ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করেছে৷ কোনো চাপ বা প্রভাবের প্রশ্নই ওঠে না৷ তদন্তে যা পাওয়া গেছে সেভাবেই প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে৷’’

পুলিশের তদন্তে বলা হয়েছে, অস্ত্র ও মাদক ইরফান সেলিমের দখলে পাওয়া যায়নি৷ তার বাড়ির যে ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে সেখানে অনেকেই যাওয়া আসা করেন৷ তবে এই দুইটি মামলায় ইরফানের বডিগার্ড ও সহযোগীরা ঠিকই আসামি হয়েছে পুলিশের তদন্তে৷ বাদ গেছে ইরফান সেলিম!

ইরফানের আইনজীবী প্রাণ নাথ জানান, ‘‘নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর ও হত্যাচেষ্টা মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে৷ এই মামলায়ও জামিনের আবেদন করা হয়েছে৷ আবেদন একবার নাকোচ হলেও আশা করছি শিগগিরই জামিন পাবেন তিনি৷’’

তিনি জানান, ভ্রাম্যমাণ আদালতের দেয়া দেড় বছরের দন্ডের বিরুদ্ধেও আপিল করা হয়েছে৷ ওই ঘটনায় আদালত জামিন দিয়েছেন৷ আর র‌্যাবের দুইটি মামলায় তো তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন৷ এখন ধানমন্ডি থানার মামলায় জামিন পেলেই তিনি কারাগার থেকে ছাড়া পাবেন৷

ধানমন্ডি থানার হত্যাচেষ্টা মামলার বাদি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা লে. ওয়াসিফ আহমেদ খান নিজেই৷ চার্জশিটে ইরফান সেলিম, তার দুই দেহরক্ষী জাহিদুল মোল্লা, এ বি সিদ্দিক দিপু ও গাড়িচালক মিজানুর রহমানকে আসামি করা হয়েছে৷

র‌্যাবের মামলা ও পুলিশের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান৷ তিনি বলেন, ‘‘র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতে দোষ স্বীকার না করলে শাস্তি দেয়ার কোনো সুযোগ নাই৷ স্বীকারোক্তি না দিলে পরবর্তী আইনি পদক্ষেপে যেতে হয়৷ আর দুইটি মামলায় যে অব্যাহতি দেয়া হলো তার বিরুদ্ধে তো রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আপিল করবেন৷ তা যদি সময়মত না করা হয় তাহলে এখানে তো প্রশ্ন উঠবেই৷ র‌্যাব কী অভিযান চালালো আর পুলিশ কী তদন্ত করল তা নিয়েই এখন সংশয় আছে৷ হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে অভিযোগ যদি অসত্য হয় তাহলে র‌্যাবের হাতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? তাই আরো তদন্ত হওয়া দরকার৷ আর রাষ্ট্রপক্ষের চুপচাপ থাকার বিষয়টিও প্রশ্নের জন্ম দেয়৷’’

মানুষের মনে ইরফান সেলিমের এই অব্যাহতি নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী নূর খান৷ তিনি বলেন, ‘‘র‌্যাব ও থানা পুলিশ দুটিই পুলিশের অধীন দুইটি সংস্থা৷ এই ঘটনায় তাদের ভূমিকা এখন পরস্পরবিরোধী৷ দুই পক্ষ একই সঙ্গে সঠিক হতে পারেনা৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা মনে হয়েছে এটা নির্দেশিত বা আজ্ঞাবহ তদন্ত৷ যেভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেভাবে তদন্ত হয়েছে৷’’

নূর খান মনে করেন, ‘‘শুধু এই একটি ঘটনাই নয়৷ আমরা এভাবে আরো অনেক আজ্ঞাবহ তদন্ত দেখতে পাচ্ছি৷ দেশের মানুষকে এই ধরনের আজ্ঞাবহ তদন্ত থেকে মুক্তি দিতে হবে৷’’