বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা

আসামিদের না ধরে পুলিশ শুধু তাদের ‘মনের খবর’ রাখছে

আসামিদের না ধরে পুলিশ শুধু তাদের ‘মনের খবর’ রাখছে

সাবেক যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলায় জড়িত আসামিদের গ্রেপ্তার করতে না পারলেও তাঁদের ‘মনের খবর’ ঠিকই জানতে পেরেছেন এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র হচ্ছে’ এমনটা মনে করে আসামিরা মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা করেছিলেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তেজগাঁও অঞ্চলের পরিদর্শক আব্দুর রউফ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা ৯ আসামির কেউই এই মামলায় আটক বা গ্রেপ্তার হননি। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদও করা যায়নি। তাহলে হামলার উদ্দেশ্যে সম্পর্কে জানলেন কীভাবে—এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সোর্সের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছি।’

আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছেন কি না, জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তাঁর আগে মামলাটি আরও তিনজন তদন্ত করেছেন। ওই তিনজন এবং তিনি নিজেও চেষ্টা করেছেন আসামিদের ধরতে কিন্তু সম্ভব হয়নি।

তবে তদন্ত কর্মকর্তা এমন দাবি করলেও গতকাল শনিবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চারজন আসামির সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় আছেন। এ মামলার আসামি মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মোজাহীদ আজমি ওরফে তান্না মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয় দিয়ে একদিন একজন তাঁকে ফোন দিয়েছিলেন। তাঁর নাম-ঠিকানা নিয়েছেন। তিনি কারণ জানতে চাইলে বলেছেন, ছাত্রলীগের বিষয়ে তাঁদের রিপোর্ট করতে হয়, সে কারণে এসব তথ্যের প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহরে হামলার বিষয়ে তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।

আরেক আসামি মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মীর আমজাদ হোসেন ওরফে আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রউফ একবার ফোন করে তাঁর নাম–ঠিকানা নিয়েছিলেন। আর একবার তিনি নিজেই একটি কাজে আব্দুর রউফকে ফোন করে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেখা করতে চাননি।

আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেরেবাংলা নগর থানা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক শহীদুল আলম খান ওরফে কাজল। তিনি বলেছেন, ঘটনার বিষয়ে তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করেনি। একদিন এক পুলিশ সদস্য বাসায় এসে তাঁর নাম–ঠিকানা নিয়ে গেছেন।

তবে তিনজনই দাবি করেছেন, ঘটনার সময় তাঁরা সেখানে ছিলেন না। মীর আমজাদের দাবি, তিনি ও তাঁর বন্ধু সাজু ইসলাম ওরফে সাজু (মামলার আসামি) ঘটনার সময় এক বন্ধুর বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে হামলার কথা জানতে পারেন। আর সাজু ইসলাম বলেছেন, মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে (গাড়িবহর এই রোডে থাকার সময় হামলা হয়েছিল) তাঁদের একটি ওষুধের দোকান ছিল। ওই দিন তাঁর ছোট ভাই রাজিবুল ইসলামকে দোকানে রেখেই তিনি শেওড়াপাড়া বিয়ের অনুষ্ঠানে যান। কিন্তু তাঁর ভাই রাজিবুলকেও আসামি করা হয়েছে।

আসামিরা বলছেন, তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। এরপরও তাঁদের গ্রেপ্তার করা যায়নি কেন, এমন প্রশ্নে আব্দুর রউফের দাবি করেন, আসামিদের কারও সঙ্গে তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ হয়নি।

২০১৮ সালের ৪ আগস্ট রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোডে মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলা হয়। তখন তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বে ছিলেন। ওই রাতে মোহাম্মদপুরে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের বাসায় যান তিনি। সেখানে নৈশভোজ শেষে ফেরার পথে তাঁর গাড়িতে হামলা চালায় অস্ত্রধারীরা। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন মোটরসাইকেলে ছিলেন। হামলার ছয় দিন পর ২০১৮ সালের ১০ আগস্ট এ ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন বদিউল আলম মজুমদার।

মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার প্রায় আড়াই বছর পর আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের ৯ নেতা-কর্মীকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। গত ১৮ জানুয়ারি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ডিবি অভিযোগপত্র জমা দিলেও প্রায় দেড় মাস পর গত শুক্রবার বিকেলে বিষয়টি জানাজানি হয়।

অভিযোগপত্রের বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এই অভিযোগপত্র যথেচ্ছাচার এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির দৃষ্টান্ত। বিষয়টি নিয়ে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।

উল্লেখ্য, মার্শা বার্নিকাট ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে ঢাকায় আসেন এবং চার বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৮ সালের ২ নভেম্বর নিজ দেশে ফিরে যান।

অন্য চার আসামির পরিচয়

মামলার ১ নম্বর আসামি ফিরোজ মাহমুদের বাড়ি বরিশালের আরজি কালিকাপুর গ্রামে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক যখন মোহাম্মদপুর এলাকার সাংসদ ছিলেন তখন তাঁর কার্যালয়ে ফিরোজের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তবে আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগের তাঁর কোনো পদবি নেই বলে জানান মোহাম্মদপুরের স্থানীয় নেতারা।

আসামি নাইমুল হাসান ওরফে রাসেল মোহাম্মদপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, আসামি সিয়াম ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী ছিলেন। আসামি অলি আহম্মেদ ওরফে জনিও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রত্যাশী ছিলেন।
বিজ্ঞাপন

সাক্ষীরা যা বলছেন

মামলার অভিযোগপত্রে ১৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনজন মামলার বাদী বদিউল আলম মজুমদার ও তাঁর পরিবারের সদস্য। ১১ জন পুলিশের সদস্য। বাকি পাঁচজনের মধ্যে শামিম আহসান পারভেজ হচ্ছেন বদিউল আলম মজুমদারের বাড়ির উল্টো পাশের বাড়ির মালিক। গতকাল মুঠোফোন তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ঘটনার দিন এলাকায় ছিলেন না তিনি। ঘটনার পরে এসেছিলেন। সে সময় পুলিশের সদস্যরা তাঁকে নানা প্রশ্ন করেছিলেন। তবে কারা হামলা করেছে বা কী কারণে হামলা হয়েছে, সে বিষয়ে কিছু না জানায় তাঁদের তেমন কিছু বলতে পারেননি। মামলায় তাঁকে যে সাক্ষী করা হবে, সে বিষয়টিও পুলিশ তাঁকে বলেনি।

আরেক সাক্ষী মো. সুজন মিয়া ঘটনার সময় শামিম আহসানের বাড়ির তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন। এখন জামালপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে থাকেন। গতকাল মুঠোফোনে তাঁকে আসামিদের নাম পড়ে শোনালে তিনি তাঁদের কাউকে চেনেন না বলে জানিয়েছেন। পুলিশ তাঁকে মামলার সাক্ষী করেছে, সেটিও তাঁর জানা নেই। তিনি বলেন, ঘটনার দিন তিনি বাড়ির চারতলা থেকে শুধু হুড়োহুড়ি আর ঢিলাঢিলি দেখেছেন। কারা করেছেন, তা দেখেননি।

শামিম আহসানের বাড়ির নিরাপত্তারক্ষী মো. জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মামলায় তাঁকে সাক্ষী করার কথা জানেন না। এই প্রতিবেদকের কাছ থেকেই প্রথম শুনলেন।

এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার দাবি, মামলার সাক্ষী করা হবে, এমনটা বললে লোকজন কথা বলতে চায় না। তাই ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের নাম–ঠিকানা এবং বক্তব্য নোট করে নিয়ে এসে পরে তাঁদের সাক্ষী করা হয়েছে।

আসামিদের সঙ্গে কথা বলেও গ্রেপ্তার না করা এবং না জানিয়ে মামলার সাক্ষী করার বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক কারণে ব্যবহার হয়, এটা তার আরেকটি উদাহরণ।’ তিনি বলেন, রাজনৈতিক কারণে অনেক মামলায় হেলাফেলা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কথা বিবেচনায় রেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ ক্ষেত্রে অন্তত সঠিক পদক্ষেপ নেবে, এটাই প্রত্যাশা।-প্রথম আলো