চলতি বছর ডেঙ্গি রোগী ৩ লাখ ছাড়িয়েছে

চলতি বছর ডেঙ্গি রোগী ৩ লাখ ছাড়িয়েছে

চলতি মৌসুমে ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী তিন লাখ ছাড়িয়েছে। বাকি সময়ে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে। সেটি চার লাখে পৌঁছালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গর্ভন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘নগরীর মশা নিবারণে সমস্যা টেকসই সমাধানে একটি রূপরেখা’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তরা এসব কথা বলেন। সেখানে অংশ নিয়ে কীটতত্ত্ববিদ, চিকিৎসক এবং কীটপ্রতঙ্গ বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন।

আলোচনায় কীটতত্ত্ববিদ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত দেশে সরকারি হিসাবে ১৫ হাজার ২২৮ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশের ৪১টি হাসপাতালের তথ্য সংগ্রহ করে এমন হিসাবের কথা বলছে।

এর বাইরেও অনেক ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী থেকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, সরকার সরকারি হিসাবের চেয়ে বাংলাদেশে ২০ থেকে ৪০ গুণ বেশি ডেঙ্গি আক্রান্ত হচ্ছে বলে ২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর জানিয়েছে স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল ল্যান্সেট।

এই হিসাব অনুযায়ী ২০ গুণ ধরলে চলতি মৌসুমে দেশে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ চার হাজার ৫৬০ জন। আর ৪০ গুণ ধরলে আক্রান্তের সংখ্যা ছয় লাখ ৯ হাজার ১২০ জন। আমরা ল্যান্সেটের সর্বনিুটিকে মানদণ্ড ধরেই আশঙ্কাজনক চিত্র দেখছি। কেননা, দেশে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা নিরুপণের পদ্ধতি ২০১৯ সালের চেয়ে কোনো উন্নতি হয়নি।

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু  আক্রান্তদের মধ্যে চলতি বছরে ৫৭ জন মারা গেছে এটা অবশ্যই বড় দুঃখজনক ব্যাপার। এটা কারো কাম্য নয়, তবে এর চেয়েও আশঙ্কার বিষয় অর্থনৈতিক। ডেঙ্গি আক্রান্ত হলেই গড়ে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। সে হিসাবে তিন লাখ চার হাজার ৫৬০ জন রোগীর চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে ৩০৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ডেঙ্গির উপদ্রব নিয়ন্ত্রণে আইন, বিধি ও নীতিমালা সংশোধন করে ‘বাংলাদেশ মশা ও কীটপ্রতঙ্গ কর্তৃপক্ষ’ নামে একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা যেতে পারে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ২৪২ বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এর পরও এ ভাইরাস পৃথিবীতে থাকবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। ডেঙ্গুর জন্য টিকা রয়েছে। এটা আবিষ্কার করেছে ফরাসিরা। কিন্তু, সেটা ব্যবহার করা হচ্ছে না।

তিনি বলেন, ডেঙ্গির ব্যাপারটি কিন্তু, সহজ-সরল ব্যাপার। ২০১৯ সালে ডেঙ্গি চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে মৃত্যুর হার বেশি হয়েছে। ডেঙ্গি চিকিৎসায় পারাসিটামল সর্বোত্তম ওষুধ।

তবে ডেঙ্গি চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। আমি দরিদ্র মানুষকে এক কোটি মশারি দিতে বলেছিলাম সরকারকে। কিন্তু, সেদিকে দৃষ্টি দিতে দেখা যায়নি। তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশনকে বলব চুরি কম করেন, ভালো মানের ওষুধ কেনার চেষ্টা করেন। কেউতো আর ভোট নিয়ে চেয়ারে বসছেন না। এজন্য এসব দিকে দৃষ্টি দেন না তারা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ তৌহিদ উদ্দীন আহমেদ বলেন, দেশে মশা মারার কোনো নীতিমালা নেই। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এবং সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদকে এ দায়িত্ব দেওয়া থাকলেও তাদের প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও সক্ষমতা নেই। প্রতি মাস ও বছরের মশার জরিপের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে সমন্বিত মশা ও কীট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, চলতি বছরের ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন পুরোপুরিভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, জরিমানা প্রদানও আইনের অংশ। এসবের আগে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। পাশাপাশি মশক নিধনের ওষুধের দাম ও আমদানি শুল্ক কমাতে হবে। তাহলে এটা ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মানুষ ক্রয় করে ব্যবহার করলে সমাধান মিলতে পারে।

মেডিকেল কীটতত্ত্ববিদ জিএম সাইফুর রহমান বলেন, তিন দিনে এক দিন জমা পানি ফেলে দিন-এ স্লোগান ভালো হবে। কোনো কারণে এটা করা সম্ভব না হলেও সপ্তাহে এক দিন ফেলে দিলেও হবে। তবে পাশাপাশি জমে থাকা পাত্রগুলো ঘষে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূঁইয়া বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের লোক দেখানো কাজ লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব মিডিয়াতে আসছে, আর তারা বড় গলা করে বলছেন অনেক কাজ করছেন। বাস্তবে মশা নিয়ন্ত্রণে তেমন কোনো কাজই হচ্ছে না। সরকারের পক্ষ থেকে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা যেটা বলা হচ্ছে, বাস্তবে আক্রান্তের সংখ্যা এর চেয়েও বেশি।

কীটতত্ত্ববিদ ও টঙ্গী সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক তসলিমা আক্তার বলেন, ঘাসফড়িং ফসলের অনেক ক্ষতি করত। এ কারণে আমাদের পাঠ্যপুস্তকে এটা পড়ানো হতো। বর্তমানে ঘাসফড়িং তেমন ক্ষতিকর নয়। এখন পাঠ্যপুস্তকে মশার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তাহলে ছোটবেলা থেকে বাচ্চারা এ ক্ষুদ্র প্রাণীটি সম্পর্কে ধারণা অর্জন করবে এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জ্ঞান হবে। এভাবে এগোলে মশা নিয়ন্ত্রণে টেকসই সমাধান সম্ভব।

সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চলনায় সেমিনারের আলোচনায় অংশ নেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডসশিপ হাসপাতালের প্রধান লেপারোস্কোপিক সার্জন ও চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সরদার এ নাঈম, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ প্রমুখ। এ সেমিনারের সভাপতিত্ব করেন সিজিএসের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী।

চলতি মাসে শনাক্ত ছাড়াল ৫ হাজার : দেশে ফের বেড়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৩২ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতেই রয়েছেন ১৮৭ জন। ঢাকার বাইরে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৪৫ জন। আগের দিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬৩।

সব মিলিয়ে চলতি মাসে ৫ হাজার ১০৪ জন ডেঙ্গু রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়ে একদিনে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গিতে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আগস্টেই মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে ১২ আর চলতি মাসে ১৩ জন। শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়, চলতি বছরে এ পর্যন্ত হাসপাতালে মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ৪৬০ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ১ হাজার ১৯৭ জন। ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি রোগী আছেন ৯৯০ জন। অন্যান্য বিভাগে ভর্তি আছেন ২০৭ জন।

এমজে/