অর্থ পাচার নিয়ে শুনানিতে হাইকোর্ট

সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

সুইস ব্যাংকসহ বিদেশি ব্যাংকে পাচার করে অর্থ রাখা ব্যক্তি, কোম্পানি ও স্বত্বার নাম–ঠিকানা এবং ওই অর্থ ফিরিয়ে আনতে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা হলফনামা আকারে জানাতে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিবাদীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। ১৪ জন বিবাদীর মধ্যে শুধু পুলিশের মহাপরিদর্শকের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে হলফনামা আকারে আজ রোববার আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

এ অবস্থায় আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে বিবাদীদের শিথিলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ ওই শুনানি হয়।

রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘গত ২৮ ফেব্রুয়রি রুল দেওয়া হয়। এত দিন হয়ে যাচ্ছে। রুলের আদেশটাই যদি বাস্তবায়ন না করেন, তাহলে আর কী বলব? কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এটা কোনো কথা হলো না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে? এ বিষয়গুলো নিয়ে তো আমাদের ভাবতে হবে, ভাবতে শিখতে হবে। শুধু আসলাম আর গেলাম—তা তো নয়। দেশ ও জাতির জন্য তো কিছু করা দরকার, কিছু করতে হবে। আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যই আপনাকে করতে হবে। শুধু সরকারই করবে—এমন তো নয়, সরকারকে সহযোগিতা করা আমাদের দায়িত্ব।’

বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও কোম্পানি পাচারের মাধ্যমে বিদেশি ব্যাংকগুলো, বিশেষত সুইস ব্যাংকে গোপনে জমা রাখা বিপুল অর্থ উদ্ধারে অবিলম্বে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল কাইয়ুম খান ও সুবীর নন্দী দাস ওই রিট আবেদন করেন। রিটের শুনানি নিয়ে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট কয়েকটি বিষয়ে রুলসহ আদেশ দেন।

এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) পক্ষ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তথ্যাদি–সংবলিত প্রতিবেদন হলফনামা আকারে আজ আদালতে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আবদুল কাইয়ুম খান। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক।

সিআইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থ পাচারের সাত মামলায় ১২ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান এবং অজ্ঞাতনামা ৪–৫ জনের কথা উল্লেখ রয়েছে। সাবেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী ওরফে সম্রাটসহ ১২ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৮ টাকা বিদেশে পাচারের তথ্য রয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়, মামলাগুলো তদন্তাধীন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলার অগ্রগতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাত হ্যাকাররা ১০১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হাতিয়ে নেয়। তার মধ্যে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা থেকে ৩৪ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার উদ্ধার করা হয়েছে।

‘অন্যরা নীরব কেন’

দুপুর ১২টার দিকে শুনানির শুরুতে আদালত বলেন, হলফনামা আকারে একটি প্রতিবেদন (কমপ্লায়েন্স) দেওয়া হয়েছে, যেখানে আটটি কেস শনাক্ত করা হয়েছে।
রুল ও অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ পড়ে শুনিয়ে রিট আবেদনকারী আইনজীবী আবদুল কাইয়ুম খান বলেন, শুধু পুলিশের মহাপরিদর্শক (১৪ নম্বর বিবাদী) থেকে হলফনামা আকারে প্রতিবেদন এসেছে। রুলের জাবাবও দেওয়া হয়নি।

রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে আদালত বলেন, এই আদালত বিবাদীদের ‘কমপ্লায়েন্স’ দিতে নির্দেশ দিয়েছিল। রিটে ১৪ বিবাদী আছেন। পুলিশের মহাপরিদর্শক ছাড়া কেনো বিবাদী প্রতিবেদন দেননি। অন্যরা নীরব কেন? কেন তাঁরা আদালতের আদেশ প্রতিপালন করেননি?

তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, এ বিষয়ে যোগাযোগ করছি। দীর্ঘদিন করোনা পরিস্থিতির কারণে কোর্ট বন্ধ ছিল। উনাদের (বিবাদীদের) কাজ করতে অসুবিধা হয়েছে। আমাদেরও যোগাযোগে অসুবিধা হয়েছে। বিবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।

আদালত বলেন, শুধু আইজিপি আদেশ প্রতিপালন করেছেন। অন্য বিবাদীরা কেন আদালতের আদেশ প্রতিপালন করেননি? আদেশ বাস্তবায়ন করতে ১ থেকে ১৩ বিবাদীকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। হলফনামা আকারে কমপ্লায়েন্স দাখিল করতে হবে।

একপর্যায়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন মানিক এক মাস সময়ের আরজি জানান। এ সময় আদালত বলেন, ‘ইট ইজ আ ভেরি ভেরি সেনসেটিভ ইস্যু। এটি নরমাল কেসের মতো, নরমাল কেস নয়। দেশের অনেক টাকা দেশের মানুষ গোপনে পাচার করে বিদেশে ও বিদেশি ব্যাংকে রেখেছে। আমরা দেখতে চাই তাদের বিরুদ্ধে বিবাদীরা কী পদক্ষেপ নিয়েছেন। আদালতের আদেশ বাস্তবায়ন এবং সুইসসহ বিদেশি ব্যাংকে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনতে পদক্ষেপ নেওয়া বিবাদীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্বত্বা তাদের নাম–ঠিকানা এবং তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা আমরা দেখতে চাই। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে কাদের নামে এসেছে, অন্তত সেই নামগুলো জানতে চাই—এগুলো আমরা দেখতে চাই।’

পরে আদালত হলফনামা আকারে পুলিশের মহাপরিদর্শকের দাখিল করা প্রতিবেদন গ্রহণ করে ২১ নভেম্বর পরবর্তী দিন রাখেন। এই সময়ের মধ্যে অপর বিবাদীদের প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।