ফিটনেসবিহীন ছিল ফেরি আমানত শাহ

ফিটনেসবিহীন ছিল ফেরি আমানত শাহ

রো রো ফেরি আমানত শাহ। বয়স ৪২ বছর। ১৯৭৯ সালে আরিচা ফেরিঘাটে যোগ দেয় এই ফেরিটি। বয়সের ভারে অসুস্থ এই ফেরিটিকে প্রায়ই মেরামতের জন্য নেয়া হতো নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ডে। ফিটনেস না থাকায় পদ্মার তীব্র স্রোতের বিপরীতে ফেরিটি চলতে হিমশিম খেতো। তারপরও দীর্ঘ পুরাতন ও লক্কর ঝক্কর এই ফেরিটি দিয়ে যানবাহন ও যাত্রী পারাপার করা হতো। এছাড়া চার মাস আগে ফেরিটি নারায়ণগঞ্জ থেকে বড় ধরনের মেরামত শেষে পাটুরিয়া ফেরিঘাটে নিয়ে আসা হলেও সম্প্রতি ফেরিটির তলদেশে একটি ফুটো হওয়ার তথ্যও রয়েছে বলে জানান ফেরির মাস্টার শরিফুল ইসলাম লিটন।

তিনি আরও জানান, বুধবার ট্রিপ নিয়ে দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়া গিয়ে ভাসমান কারখানা মধুমতিতে ফেরিটি মেরামত করার কথা ছিলো। কিন্ত তার আগেই ঘটে গেলো দুর্ঘটনা।

সকালে দৌলতদিয়া থেকে পাটুরিয়ার উদ্দেশ্যে মাঝ নদী পার হওয়ার পর ফেরিতে পানি ওঠার বিষয়টি তিনি টের পান। ভালো ভাবেই তিনি ফেরিটি পাটুরিয়া ঘাটে নোঙ্গর করান। এর পর যানবাহন আনলোড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফেরিটি কাত হয়ে এক পাশ ডুবে যায়।

দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া খুলনা থেকে ছেড়ে আসা কাভার্ডভ্যান চালক আসলাম ও তার সহযোগী প্রবীর বলেন, আমরা গাড়িতেই ছিলাম কয়েকজনকে বলতে শুনেছি ফেরিতে পানি উঠছে। নদীতে স্রোত থাকলে ফেরিতে পানি উঠে এটা সব সময় দেখি এজন্য গুরুত্ব দেই নাই। যখন ফেরি পারে ভিড়ল তখন দুমড়ে মুড়চে একটা গাড়ি আরেকটা সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছিল। তখন গাড়ি থেকে নেমে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার চেষ্টা করি। ঝাঁপ দেয়ার পর ফেরি উল্টা হয়ে দেখি আমার উপর আসছে। তখন মনে করছি আর বাঁচুম না। কয়েকবার দম আটকে যায়। ডুবে যাওয়া গাড়ির সঙ্গে জোরে জোরে অনেক ধাক্কা খেয়েছি। তার পর নদী থেকে তীরে উঠি।

 

এদিকে বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত উদ্ধার তৎপরতায় হতাহতের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স উপসহকারী পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম জানান, তাদের দুটি টিম উদ্ধার কাজ করছে। ঢাকা থেকে ৩টি টিমসহ মোট ৫টি টিম কাজ করছে।

বিআইডব্লিউটিসির এজিএম (মেরিন) আব্দুস সাত্তার জানিয়েছেন, ৪২ বছর আগের ফেরি আমানত শাহ দীর্ঘদিন ধরে চলছিল ফিটনেসবিহীন ভাবে। এবিষয়ে আবেদন করাও হয়েছে।

 

বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান জানান, আমানতশাহ ফেরিটি ১৯৭৯ সালে ফেরি বহরে যোগ হয়। ফেরিটি কোন ত্রুটি ছিলো কি না তা জানা নেই। প্রাথমিক যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে ফেরির তলদেশ ছিদ্র হয়ে পানি উঠে ফেরিটি ডুবে গেছে। আমাদের দেশে ফেরি ডুবির ঘটনা এটাই প্রথম।

এদিকে বুধবার ফেরি ডুবির ঘটনার পর থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ৪ ট্রাক ও ১টি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে। রাত ৮টার পর উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা উদ্ধার তৎপরতা বন্ধ রাখে। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে পুনরায় উদ্ধার তৎপরতায় যোগ দেয়। এছাড়া উদ্ধার কাজে যোগ দিতে মুন্সিগঞ্জ থেকে উদ্ধাকারী জাহাজ প্রত্যয় রাতে পাটুরিয়া ঘাটে আসার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি।

 

উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার কমান্ডার এস এম ছানোয়ার হোসেন বলেন, ধারণা করা হচ্ছে, ফেরির পাটাতন ফেটে পানি ওঠায় এটি ডুবে যায়। ফেরি আমানত শাহ’র যে ওজন তাতে কোন কুল কিনারা পাবেনা উদ্ধারকারী জাহাজটি। ফেরির অবকাঠামোর ওজন ১ হাজার টন। সেক্ষেত্রে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজার উদ্ধারে সক্ষমতা মাত্র ৬০ টন। আরেকটি উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় যার উদ্ধারের সক্ষমতা রয়েছে ২৫০ টন। সবমিলিয়ে হাজার টন ওজনের ফেরি আমানত শাহ উদ্ধারে প্রত্যয়ও কোন কাজে আসবে না।

এদিকে ফেরি ডুবির ঘটনায় নৌমন্ত্রণালয় ও মানিকগগঞ্জ জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার সাবেক নৌ মন্ত্রী শাহজাহান খান দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে জানান, পাটুরিয়া ঘাটে ফেরি ডুবির ঘটনায় নৌমন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সুলতান আব্দুল হামিদকে প্রধান করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির গঠন করা হযেছে। একই দিকে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ জানান, ফেরি ডুবির ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সানোয়ারুল হককে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।