শাবিতে পুলিশি হামলা: ক্ষোভের ঢেউ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও

শাবিতে পুলিশি হামলা: ক্ষোভের ঢেউ অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের আরও ৪ বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশি হামলা চালিয়েছেন- এমন অভিযোগ তার অপসারণের দাবি জানিয়েছে বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন। সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনস্থ কলাভবন ক্যাফেটেরিয়ার আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে এই দাবি জানান সংগঠনগুলোর নেতারা। এর আগে, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকা থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে।

ছাত্র ফেডারেশনের একাংশের সভাপতি মিতু সরকারের সভাপতিত্বে সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ছাত্র ফেডারেশনের (গণসংহতি) সভাপতি গোলাম মোস্তফা, ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ রায়, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট(মার্কসবাদী) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জয়দীপ ভট্টাচার্য, ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি জহর লাল রায়, গনতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সহ-সভাপতি সাইদুল হক নিশান, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা দীপন চাকমা প্রমুখ।

সমাবেশে নেতারা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কেন পুলিশ আসবে? পুলিশ কার টাকায় চলে? শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলন ধামা চাপা দেওয়ার জন্য হল-ক্যাম্পাসে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু যতদিন শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নেওয়া হবে ততদিন আন্দোলন চলবে।

নেতারা আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের দাবি না মানা পর্যন্ত সকল কার্যক্রম বন্ধ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের আবাসিক কোয়ার্টারে থাকতে পারবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। আমরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে স্যালুট জানাই। প্রশাসন, পুলিশ ও ছাত্রলীগ মিলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসের কারখানায় পরিণত করেছে।

সভাপতির বক্তব্যে মিতু সরকার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পুলিশকে ছাত্রদের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর জন্য ডেকে এনেছে। তাদের ওপর হমলার পরও তারা আন্দোলন ছেড়ে যায়নি। আমি শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাই।

তিনি বলেন, এই রাষ্ট্র আজ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে মারার জন্য শাবিপ্রবির উপাচার্য পুলিশ ডেকে এনেছে, তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আন্দোলন বন্ধ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হল-ক্যাম্পাস এবং ক্লাস-পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন হয়েছে।

আজ সোমবার দুপুর ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে শিক্ষার্থীরা ওই মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান এবং হামলার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। একই ঘটনায় গত রোববার রাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

মানববন্ধনে ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সভাপতি রাকিবুল হক বলেন, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে এত অভিযোগ থাকার পরও সরকার যেভাবে তাঁকে সমর্থন দিয়েছে, আমরা আশা করছি, শাবিপ্রবির উপাচার্যের ব্যাপারে সরকার তেমন অন্ধ সমর্থন দেবে না।’

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি দীপঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, ‘আজ সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে একাত্মতা পোষণ করছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেন বলেন, বাংলাদেশে যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তার কোনোটাই ছাত্রবান্ধব নয়। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছাত্রবান্ধব হোক। নিজেদের অধিকার আদায় করতে শিক্ষার্থীদের যেন আর রক্ত ঝরাতে না হয়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিফলক চত্বরে এই কর্মসূচি পালিত হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মহব্বত হোসেনের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘যে ভিসি (উপাচার্য) বুলেট মারে, সে ভিসি চাই না’, ‘ছাত্রসমাজ এক হও, লড়াই করো’, ‘আমার ক্যাম্পাস ছেড়ে দাও, পুলিশ তুমি বাড়ি যাও’, ‘ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী হামলার বিচার চাই, করতে হবে’ প্রভৃতি স্লোগান সংবলিত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।

কর্মসূচিতে রাকসু আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আবদুল মজিদ বলেন, এই হামলার সঙ্গে যে সন্ত্রাসী সংগঠন, পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা জড়িত, তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। আর কেউ যেন শিক্ষার্থীদের ওপর কোনো মহল আঙুল তুলতে না পারে, শিক্ষার্থীদের গায়ে হাত দিতে না পারে, শিক্ষার্থীদের ওপর চোখ রাঙাতে না পারে।

রাবি শাখা নাগরিক ছাত্র ঐক্যের সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা স্বৈরাচারের সহায়ক ভূমিকা একনিষ্ঠভাবে পালন করছেন। এখন যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নীলচাষি, আর প্রশাসন হচ্ছে ইংরেজ। নীলচাষিদের ব্রিটিশরা যে রকম নির্যাতন করত, সে রকমভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা সব সময় সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছেন। সেই ভূমিকা যেন অক্ষুণ্ন থাকে, সে জন্য সবার এক হয়ে কাজ করতে হবে।

ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রিফাত বলেন, ক্যাম্পাসে উপাচার্য হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ অভিভাবক। সেই অভিভাবকের মদদে যখন পুলিশ বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়, তখন বুঝে নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায়। উপাচার্যের প্রত্যক্ষ মদদে পুলিশ বাহিনী ছাত্রসমাজের ওপর হামলার মতো ন্যক্করজনক কাজ করেছে। তাঁরা শুধু দায়িত্ব নিয়ে পড়ে থাকেন, শিক্ষার্থীদের বিষয় নিয়ে ভাবেন না।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার প্রতিবাদে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন করেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবার দুপুরে ক্যাম্পাসের হাদী চত্বরে ওই মানববন্ধন হয়।

বক্তারা বলেন, ‘সব সময় দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা একক ক্ষমতা ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের ওপর দমন–পীড়ন চালান। পান থেকে চুন খসলেই শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে আসে নিয়মের খড়্গ। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের একক ক্ষমতা, ঔপনিবেশিক শাসন ও এগুলোর চর্চা বন্ধ হোক। ক্যাম্পাসে কিছু করলেই পুলিশ দিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটানো হয়।’ ক্যাম্পাসে পুলিশ থাকবে কেন, সেই প্রশ্ন করেন তাঁরা।

বক্তারা আরও বলেন, একজন শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেন তখন ধরে নেওয়া হয় তিনি নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় হলো শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে অনিরাপদ জায়গা। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আঘাত করলে তা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল ও বিক্ষোভ

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন, মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। আজ সোমবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এসব কর্মসূচি পালন করা হয়।

সমাবেশে শিক্ষার্থীরা বলেন, শাবিপ্রবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, বিশেষ করে ছাত্রীদের ওপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশের হামলা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক ঘটনা। বর্বরোচিত হামলার ঘটনা দেশের সব শিক্ষার্থীদের মর্মাহত করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর এমন হামলা নিন্দারও অযোগ্য। ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আলিশা মুনতাজের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য দেন শিক্ষার্থী সামশাদ নওশীন, গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ হোসেন, বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরিন, সুজয় শুভ প্রমুখ।

মানববন্ধন ও সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক হয়ে ভোলা সড়কের মোড় হয়ে আবার ক্যাম্পাসে এসে শেষ হয়।

প্রসঙ্গত, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ ও সহকারী প্রাধ্যক্ষদের পদত্যাগ, হলের যাবতীয় অব্যবস্থাপনা দূর করে সুস্থ-স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত এবং ছাত্রীবান্ধব ও দায়িত্বশীল প্রাধ্যক্ষ কমিটি নিয়োগের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার রাতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। আন্দোলন কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় গতকাল রোববার বেলা পৌনে তিনটার দিকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ তাঁর কার্যালয় থেকে বের হয়ে ডিনদের এক সভায় যাওয়ার সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভের মুখে পড়েন। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পুলিশ উপাচার্যকে মুক্ত করতে ভবনের ভেতরে ঢুকতে চাইলে আন্দোলনকারীরা বাধা দেন। তখন পুলিশ শটগানের গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার পাশাপাশি লাঠিপেটা করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেন।