সিলেটে বন্যা: জনপ্রতি সরকারি বরাদ্দ ৬ টাকা ৫৫ পয়সা, চাল আধা কেজিরও কম

সিলেটে বন্যা: জনপ্রতি সরকারি বরাদ্দ ৬ টাকা ৫৫ পয়সা, চাল আধা কেজিরও কম

মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর এলাকার কাউহানি গ্রাম থেকে কল করেন কায়েস আহমেদ। বন্যায় বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে গতকালই এখানকার মোবাইল নেটওয়ার্ক পুরোপুরি সচল হয়েছে। সৌরবিদ্যুতে মোবাইল ফোনেও চার্জ দিতে পেরেছেন কায়েস।

কায়েস জানান, গত এপ্রিলের বন্যায় তার গ্রামের মানুষ অল্প কিছু আধপাকা ধান ঘরে তুলতে পেরেছিলেন। এবার নষ্ট হয়েছে পুরোটাই। গ্রামের ২০০ পরিবার গত কয়েকদিন ধরে স্থানীয় বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র ও অপেক্ষাকৃত উঁচু বাড়িগুলোতে একসঙ্গে তীব্র কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু ৭ দিনেও এই গ্রামে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি।

কাউহানি গ্রামটির অবস্থান সুনামগঞ্জের মধ্যনগর ও তাহিরপুর উপজেলার মধ্যবর্তী জায়গায়। কায়েস বলেন, 'নেটওয়ার্ক পাওয়ার পর ফেসবুকে দেখলাম অনেকে মধ্যনগর বা তাহিরপুরে ত্রাণ দিচ্ছেন। সবাই এসে উপজেলা সদরের আশেপাশের গ্রামগুলোতেই ত্রাণ দিয়ে যাচ্ছেন। অথচ ভাটিতে যে শত শত মানুষ খেয়ে না খেয়ে আছে তার খবর কেউ রাখছে না।'

গতকাল সিলেট থেকে সুনামগঞ্জের যাত্রাপথেও একই রকম পরিস্থিতি দেখেছেন দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদক। বন্যায় আটকে পড়া সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার উত্তর খুরমা ইউনিয়নের একলিমনগর গ্রামের বাসিন্দারাও সোমবার পর্যন্ত কোনো ত্রাণ সহায়তা পাননি। এ অবস্থায় গতকাল মঙ্গলবার সেনা সদস্যরা সেখানে ত্রাণ নিয়ে যান।

একইরকম অবস্থা সিলেট বিভাগের বন্যাকবলিত প্রায় প্রতিটি এলাকায়।

এসব জায়গায় ত্রাণের জন্য হাহাকার এই পর্যায়ে পৌছেছে যে, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় সরাসরি ত্রাণ দিতে না পের বিমানবাহিনী হেলিকপ্টার থেকে 'এয়ারড্রপ' পদ্ধতিতে ত্রাণ বিতরণ করে। সোমবার সেই ত্রাণ নিতে গিয়ে গুরুতর আহত হন অন্তত ১০ জন। এরমধ্যে বিপ্লব মিয়া নামে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

সিলেট বিভাগের বন্যাকবলিত ৪ জেলার জেলা প্রশাসনের ভাষ্য, তাদের কাছে পর্যাপ্ত ত্রাণের মজুত আছে। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দূরবর্তী গ্রামগুলোতে ত্রাণ নিয়ে যেতে এখনো সমস্যা হচ্ছে।

তবে বন্যার্তদের জন্য সরকারি বরাদ্দের যে হিসাব প্রশাসন দিয়েছে তাতে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণের পরিমাণ খুবই নগণ্য।

সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুসারে, সিলেট জেলার ১৩ উপজেলার সবগুলো, সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলার সবগুলো, মৌলভীবাজারের ৭টি ও হবিগঞ্জের ৬টি উপজেলা এখন বন্যাকবলিত।

এসব এলাকার আনুমানিক ৪৫ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। এদের ভেতর ৪ লাখ ৪ হাজার মানুষ ১ হাজার ৪৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া লক্ষাধিক মানুষ নিজের ঘর ছেড়ে অন্যের ঘরে, সড়কের ওপরে ও বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন।

সরকারি হিসাবে সিলেট বিভাগের বন্যাকবলিত এই বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য এখন পর্যন্ত বরাদ্দ হয়েছে ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ১ হাজার ৯৫২ টন চাল ও প্রায় ৩০ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার।

এই তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বন্যাকবলিত ৪৪ লাখ মানুষের বিপরীতে জনপ্রতি বরাদ্দ দঁড়ায় ৬ টাকা ৫৫ পয়সা ও ৪৪০ গ্রাম চাল।

আর যদি এ বরাদ্দ কেবল সরকার নিয়ন্ত্রিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে থাকা মানুষের সহযোগিতায় দেওয়া হয়, তাহলে প্রত্যেককে ৪ কেজি ৮৮০ গ্রাম চাল ও ৭৩ টাকা ৭৫ পয়সা করে দেওয়া যাবে।

এ ব্যাপারে সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেনের ভাষ্য, 'ত্রাণ পর্যাপ্ত আছে। প্রয়োজনে আরও আসবে। ত্রাণের কোন ঘাটতি নেই। কেবল সরকারি ত্রাণ নয়, বেসরকারি পর্যায় থেকেও বিপুল পরিমাণে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি বন্যাকবলিত প্রতিটি মানুষের কাছে ত্রাণ পৌছে দিতে।'

মোশাররফ হোসেন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার বন্যাকবলিত সিলেট অঞ্চল পরিদর্শন করে সিলেট ও সুনামগঞ্জের বন্যা আক্রান্ত প্রতিটি উপজেলার জন্য ৫ লাখ টাকা করে মোট ১ কোটি ২০ লাখ টাকা তার নিজস্ব তহবিল থেকে বরাদ্দ দিয়েছেন।

তবে প্রশাসন যখন ত্রাণ সহায়তার ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি সহায়তার ওপর নির্ভরতার কথা বলছেন, তখন ত্রাণের জন্য হাহাকার আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার একজন ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'অজস্র মানুষ বন্যায় কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের ত্রাণ প্রয়োজন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এর পরিমাণ খুবই কম।'

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইকবালনগরের বাসিন্দা বিনা বানু বলেন, 'বন্যা আসার পর আমরা পাশের এক প্রবাসীর ভবনে আশ্রয় নিয়েছি। সাথে করে যে খাবার আনতে পেরেছিলাম, তা দিয়ে ২ দিন চলছে। এরপর থেকে খেয়ে না খেয়ে সময় কাটছে।'

খাবারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির কষ্টও ভোগাচ্ছে বানভাসিদের। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু জায়গায় বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করা হলেও সরকারিভাবে এর কোনো সংস্থান করা হচ্ছে না।

সিলেট-সুনামগঞ্জ মহাসড়কের মাহমুদনগর এলাকায় সড়কের ওপর আশ্রয় নেওয়া এক বৃদ্ধা জানান, বন্যা শুরুর পর থেকে বৃষ্টির পানি খেয়েই তাদের দিন কাটছে।

এদিকে প্রশাসন যখন ত্রাণ নিয়ে দূরবর্তী এলাকায় পৌঁছাতে সমস্যার কথা বলছে, তখন বেসরকারি উদ্যোগে দূরবর্তী জায়গায় ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

প্রিতম দাস নামের এমন একজন বলেন, 'ব্যক্তি উদ্যোগে আমরা সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার আলিগাঁও ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের ৬০০ মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছি। বন্যা শুরু হওয়ার ৬ দিন পর আমরাই প্রথম ত্রাণ সহায়তা নিয়ে এসব গ্রামে পৌঁছাই।'

সার্বিক বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন), সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর ভাষ্য, 'দেশে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য স্বতন্ত্র একটি মন্ত্রণালয় আছে। অথচ এই সঙ্কটে তাদর কী প্রস্তুতি ছিলো, তা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।'

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় যথাযথ সমন্বয়ের নিরিখে প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও পেশাজীবিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত বলেও মনে করেন তিনি।