গ্যাস উত্তোলনের টাকায় এলএনজি আমদানি

গ্যাস উত্তোলনের টাকায় এলএনজি আমদানি

দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে গঠন করা হয়েছিল গ্যাস উন্নয়ন তহবিল। সেই তহবিলের টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানিতে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এলএনজি আমদানির জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নেওয়ার অনুমোদন পেয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ৬ জুলাই এ ঋণের বিষয়ে সম্মতি দেয়। এ-সংক্রান্ত চিঠিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, এলএনজি আমদানির লক্ষ্যে সাময়িকভাবে ঋণ প্রদানের সম্মতি দেওয়া হলো।

দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য গঠন করা তহবিল থেকে ঋণ নিয়ে এলএনজি আমদানি করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে যতটুকু জোর দেওয়ার দরকার ছিল, তা দেওয়া হয়নি, বরং আগ্রহই ছিল গ্যাস আমদানিতে।

এখন বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিতে বিপুল ব্যয় করতে হচ্ছে। গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে হয়েছে। জ্বালানি বিভাগও অর্থসংকটে পড়েছে। এখন তারা আমদানির জন্য অর্থ নিচ্ছে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য মকবুল ই ইলাহী প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের জন্য গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে ভোক্তার টাকায়। এ তহবিল থেকে অর্থ নিতে কমিশনের অনুমতি নিতে হয়। এলএনজি কিনতে ঋণ দেওয়ার বিষয়টি কমিশনের জানা নেই।

বিইআরসি ২০০৯ সালের ৩০ জুলাই গ্যাসের দাম গড়ে ১১ শতাংশের কিছু বেশি হারে বাড়িয়ে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করে, যা কার্যকর হয় ওই বছরের ১ আগস্ট। ২০১৯ সালের ৩০ জুন ভোক্তা পর্যায়ে ৩৮ দশমিক ২ শতাংশ বাড়ানো হয় গ্যাসের দাম। তখন দামের একটি অংশ (প্রতি ঘনমিটারে ৪৬ পয়সা) গ্যাস উন্নয়ন তহবিলে জমার আদেশ দেওয়া হয়।

জ্বালানি মন্ত্রণালয় ২০১২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নীতিমালা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, পেট্রোবাংলা গ্যাস উন্নয়ন তহবিল নামে একটি ব্যাংক হিসাব খুলে এ হিসাবে অর্থ জমা করবে। দেশীয় কোম্পানিগুলো গ্যাস অনুসন্ধান, উৎপাদন, উন্নয়ন ও সঞ্চালনে প্রকল্প নিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ পাবে এই তহবিল থেকে। কোনো প্রকল্প লাভজনক হলে অর্থ সুদসহ ফেরত দিতে হবে। লাভজনক না হলে টাকা অনুদান হিসেবে গণ্য হবে।

বিইআরসির বার্ষিক প্রতিবেদন (২০২০-২১) অনুযায়ী, ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত এ তহবিলে সংগ্রহ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। আর তহবিল থেকে গ্যাস অনুসন্ধানের সরঞ্জাম কেনা এবং অনুসন্ধানসহ ৩৫টি প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৩০টি বাস্তবায়িত হয়েছে, ৫টি চলমান।

দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এখন দৈনিক ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে, যা বছর দুয়েক আগেও ২৭০ কোটি ঘনফুট ছিল। সরকার কয়েক মাস আগেও বিদেশ থেকে আমদানি করে ৮৫ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করত। ৫০ কোটি ঘনফুট আসে কাতার এবং ওমানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়। আর বাকি ৩৫ কোটি ঘনফুট খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে কেনা হতো, যা আপাতত বন্ধ রয়েছে। কারণ, বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এদিকে গত জুনে বিইআরসি এক দফা বাড়িয়েছে গ্যাসের দাম।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অর্থসংকটের কারণে জ্বালানি বিভাগ ৪ জুলাই গ্যাস উন্নয়ন তহবিল থেকে পেট্রোবাংলাকে দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিতে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেয়। এরপর অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে সম্মতি দেয়। এর আগে ২০২১ সালে পেট্রোবাংলা গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের তিন হাজার কোটি টাকা নিজের উদ্বৃত্ত আয় দেখিয়ে অর্থ বিভাগকে দিয়েছিল।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, এই টাকাটা আসলে ঋণের নামে নিয়ে নেওয়া হলো। ভোক্তারা এটিকে বৈধ মনে করে না। তিনি বলেন, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোর না দিয়ে আমদানির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে।

গ্যাস উন্নয়ন তহবিল করা হয়েছিল সরবরাহ ব্যয় কমাতে। এখন এই তহবিল থেকে টাকা ঋণের নামে নিয়ে উচ্চমূল্যের গ্যাস আমদানি করে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে। শামসুল আলম আরও বলেন, জ্বালানি বিভাগ অর্থের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখন ন্যায়-অন্যায় বিবেচনা করা হচ্ছে না।